চট্টগ্রাম ব্যুরো: কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘কারিতাস বাংলাদেশ’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে বছরব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সূচনা করতে যাচ্ছে কারিতাস।
বুধবার (২৪ নভেম্বর) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে কারিতাসের সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (কর্মসূচি) এবং সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক জেমস গোমেজ।
বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া অনুষ্ঠানমালার মধ্যে আছে— সকাল ৮টায় নগরীর সেন্টপ্লাসিড স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে শোভাযাত্রা, সকাল ৯টায় মোটেল সৈকত প্রাঙ্গণে জাতীয় ও কারিতাসের পতাকা উত্তোলন, বৃক্ষরোপণ, এরপর প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকার জনসাধারণকে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশে সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৯ জুন সংস্থাটি সরকারের অনুমোদন পায়। ১৯৭৬ সালে কারিতাস বাংলাদেশ নাম নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৭২ সালে অনুমোদনের পর থেকে গত ৫০ বছরে কারিতাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক কোটি মানুষকে নানামুখী সেবা দিয়েছে, যাদের মধ্যে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত যৌনকর্মী থেকে শুরু করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে। বর্তমানে ১১২টি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ এর সুফলভোগীর আওতায় আছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কারিতাস পরিচালনা করছে ১৮২টি ইউনিট অফিস, ১০টি ট্রেনিং সেন্টার, ২৪৬টি সাইক্লোন সেন্টার, ১১টি টেকনিক্যাল স্কুল, ৩২টি যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ নিরাময় কেন্দ্র, ২টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র, ৯টি মাদকাসক্ত, সেক্স ওয়ার্কার, পথশিশু ও নির্যাতন বিরোধী সহায়তা কেন্দ্র এবং ৩৮টি ডে কেয়ার ও হোম কেয়ার কেন্দ্র।
কারিতাসের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর শান্তিবাগে। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক কার্যালয়গুলো হচ্ছে— বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, দিনাজপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেট। দেশের ৫৩ জেলার ১৮৭টি উপজেলায় কারিতাস কাজ করছে।
বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সমতাভিত্তিক, ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মানে আরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমর্থন লাভ ও তাদের সেবাকাজে সহযোগিতা দানে উদ্বুদ্ধ করা, প্রতিবেশীকে ভালোবাসা ও দরিদ্রকে সেবাদানে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করাসহ ছয়টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কারিতাস সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আয়োজন করেছে।
বছরব্যাপী আয়োজনের মধ্যে আছে— চট্টগ্রামে উদ্বোধনের পর সব কর্মঅঞ্চলে অনুষ্ঠানের আয়োজন, প্রকাশনা, গবেষণা ও কো-কারিকুলাম তৈরি করা, সম্মাননা প্রদান, মতবিনিময় সভা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, বৃক্ষরোপণসহ আরও নানা অনুষ্ঠান। আগামী বছর রাজধানীতে হবে বর্ণাঢ্য সমাপনী অনুষ্ঠান।
কারিতাস বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিশপ জেভার্স রোজারিও সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কারিতাস শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয়, মানুষের উন্নয়নে বেশি কাজ করে। সেই উন্নয়ন আর্থিক, মানবিক কিংবা ধর্মীয় উন্নয়ন। কারিতাস যে শুধু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের সেবা দেয়, তা নয়। বরং অন্য ধর্মের মানুষদের জন্য আরও বেশি কাজ করে। এখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য কারিতাসের অনেক কাজ আছে। আমরা বিশ্বাস করি, কারিতাস একা কিছুই করতে পারবে না। সরকারসহ সবার সঙ্গে মিলে কারিতাস মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে, দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। আমরা চাই সব মানুষের মর্যাদা যেন সমান হয়, বিশ্বশান্তি, ভ্রাতৃত্ব যেন প্রতিষ্ঠা হয়।’
কারিতাস বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেমস রমেন বৈরাগী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে পুনর্বাসনে কারিতাস একমাত্র সংগঠন হিসেবে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে অনেক কাজ করেছে। সেসময় সরকারের হাতে টাকা ছিল না, সংগঠিত শক্তি ছিল না। সরকারকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের কাছে বিশেষভাবে ধরনা দিতে হয়েছে। কারিতাস ওই সময় মানব উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেছিল। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছিল।’
জেমস গোমেজ বলেন, ‘কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমরা শুরু থেকেই কাজ করছি। সেখানে প্রথম দিকে আমরা যখন খাদ্য সহায়তা দিয়েছি, তখন বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও কাজ শুরু করেনি। তাদের জন্য শেল্টার, প্রোটেকশনসহ আরও বিভিন্ন খাতে আমরা কাজ করেছি। এখন আমরা নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ জোর দিয়ে কাজ করছি। গত অর্থবছরে আমরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬৫ কোটি টাকার কাজ করেছি।’
নির্বাহী পরিচালক সেবাস্টিয়ান রোজারিও বলেন, ‘কারিতাসের চেয়ে অনেক বড় বড় এনজিও দেশে কাজ করে। কিন্তু কারিতাস তার সাধ্য অনুযায়ী নিজেরা যেমন কাজ করে, তেমনি দুইশর বেশি এনজিওকে আর্থিক সহযোগিতা দেয়। সেই এনজিওগুলো নিজ নিজ লক্ষ্য অনুযায়ী সমাজের উন্নয়নে, জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। কারিতাসের ৫০ বছর পূর্তি আমাদের জন্য অনেক গর্বের। আমরা চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের সূচনা করছি। বছরব্যাপী কর্মসূচি সারাদেশে বিশেষ করে আমাদের কর্মএলাকাগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য আছে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কারিতাস বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেমস রমেন বৈরাগী, নির্বাহী পরিচালক সেবাস্টিয়ান রোজারিও, পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) সোয়াকিম গোমেজ, আঞ্চলিক পরিচালক সুক্লেশ জর্জ কস্তা, কমিউনিকেশন ম্যানেজার শিবা মেরী ডি রোজারিও এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক রিমি সুবাস দাস।