আবরার কিলিং মিশনে যেভাবে অংশ নিয়েছিল আসামিরা
২৭ নভেম্বর ২০২১ ২৩:১৭
ঢাকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণার জন্য রোববার (২৮ নভেম্বর) দিন ধার্য রয়েছে। এদিন দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করবেন।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরে-বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে আবরার ফাহাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, শিবির সন্দেহে তাকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে মেরেছে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
তবে আবরার ফাহাদকে হত্যার পেছনে মোট ২৫ জন শিক্ষার্থী জড়িত মর্মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন। অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ১৯ জন। এছাড়া তদন্তে আরও ছয় জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ২২ জন কারাগারে রয়েছেন। অপর তিন জন পলাতক।
আবরার ফাহাদের কিলিং মিশনে এই ২৫ জনের একেকজন একেকরকম ভূমিকায় ছিল। মামলার চার্জশিটে আবরার কিলিং মিশনের নির্মম চিত্র তুলে ধরেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
ঘটনার সূত্রপাত
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, আবরার এবং আসামিরা বুয়েটে শেরে বাংলা আবাসিক হলে থাকতেন। আবরারের রুমমেট মামলার এজাহার বর্হিভূত আসামি মিজানুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও সূচনাকারী। ওই বছরের ২ অক্টোবর থেকে ৪ অক্টোবরের মধ্যে যেকোনো সময় মেহেদী হাসান রবিনকে বলে ‘আবরারকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়’। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মেহেদী হাসান বিষয়টি তাদের ‘SBHSL, ১৫+১৬’ গ্রুপসহ অপর আসামিদের ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে জানায়।
মিটিংয়ে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত
ওই বছরের ৪ অক্টোবর হলের ক্যান্টিনে মেহেদী হাসান ও ইশতিয়াক মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ, আকাশ, তাবাকখারুল, মনিরুজ্জামান, মেফতাহুল ইসলামসহ অন্যান্য আসামিরা উপস্থিত থেকে মিটিং করে। মিটিং চলাকালীন সিদ্ধান্ত মোতাবেক আবরার রুমে আছে কি না একাধিক আসামিদের পাঠিয়ে খোঁজ নেয়। কিন্তু আবরার গ্রামের বাড়ি থাকায় পরদিন মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে হোসেন মোহাম্মদ তোহা, আকাশ, মাজেদুর রহমান, মোর্শেদ আমত্য, মোয়াজসহ গেস্ট রুমে একত্রিত হয়ে মিটিং করে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মুজতবা রাফিদ তার সহযোগী ইফতি মোশাররফ সকাল ও মেহেদী হাসান রবিনকে জানায়, সে বাড়ি যাবে; আবরারকে ধরলে আজই ধরতে হবে।
আসামিরা ২০১১ নম্বর রুমে একত্রিত হয় রাত ৮টার পর
আসামি তোহা ও সামছুল আরেফিন অপর আসামি সকালকে জানায়, আবরার গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। এই খবর পাওয়ার পর পরই আসামিরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপরাধ সংঘটনের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ে ২০১১ নম্বর রুমে একত্রিত হয় রাত ৮টার পর। আসামি মেহেদী হাসান ও ইফতি মোশাররফের নির্দেশে এহতেশামুল রাব্বি, মুনতাসির আল জেমী, নাজমুস সাদাত আবরারের রুমে যায়। তারা গিয়ে দেখে, আবরার ঘুমোচ্ছে। তানিম আবরারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, ‘বড় ভাইয়েরা তোকে ডাকছে, ২০১১ রুমে যেতে হবে।’ তখন আবরার ফাহাদ বলে, ‘কেন?’ তখন তানিম বলে, ‘গেলেই দেখতে পাবি।’ এই বলে আসামিরা আবরারকে সঙ্গে নিয়ে তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, একটি টাচ ও একটি বাটন মোবাইল ফোন ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে যায়।
তাবাককারুল ইসলাম, ইফতি মোশাররফ, মুজতবা রাফিদ আবরারের মোবাইল ও ল্যাপটপ চেক করতে থাকে। তারা আবরারের মোবাইলে শিবিরের তথ্য পেয়েছে বলা মাত্র মেহেদী হাসান ক্ষিপ্ত হয় এবং চোখ থেকে চশমা সরানোর জন্য আবরারকে নির্দেশ দেয়। আবরার চোখ থেকে চশমা সরিয়ে নেওয়ামাত্র মেহেদী হাসান প্রচণ্ড জোরে তার মুখে কয়েকটি চড়-থাপ্পড় মারে। এরই মধ্যে মোর্শেদ অমর্ত্য কাঠের স্ট্যাম্প নিয়ে আসে। এক পর্যায়ে ইফতি মোশাররফ প্রথমে আবরারকে জোরে চড়-থাপ্পড় মেরে ক্রিকেট স্ট্যাম্প হাতে নিয়ে তার পিঠে, পায়ে, হাতেসহ বিভিন্ন স্থানে নির্মমভাবে আঘাত শুরু করে। এতে স্ট্যাম্পটি ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়। তখন এহতেশামুল রাব্বি আরেকটি স্ট্যাম্প নিয়ে এলে অনিক সরকার সেটি নিয়ে আবরারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জোরে একাধারে ৫০/৬০টি আঘাত করে। এতে আবরার রুমের মেঝেতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম, শামীম বিল্লাহ স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে আঘাত করতে থাকে।
বাঁচার চেষ্টায় আবরারের মিনতি
মেফতাহুল জিয়ন স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে করতে সে শিবির করে কি না জিজ্ঞাসা করে। তখন আবরার তাদের কাছ থেকে বাঁচার চেষ্টায় আকুল মিনতি করেও রক্ষা পায়নি। বরং নির্মমভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাত ১১টার পর এস এম সেতু রুমে ঢুকেই আবরারকে মারার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তখন অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেতুকে বলে, ‘সে কোনো তথ্য দিচ্ছে না।’ তখন সেতু তাদের উদ্দেশে বলে, ‘মারতে থাক’। এ নির্দেশের ফলে আসামিরা মাত্রাতিরিক্তভাবে স্ট্যাম্প, স্কিপিং রোপ দিয়ে জোরে জোরে আবরারকে মারতে থাকে।
অনিক সরকার ও ইফতি মোশাররফ স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করা ছাড়াও কনুই দিয়ে প্রচণ্ড জোরে নির্মমভাবে আবরারের পিঠে আঘাত করে। অপরাপর আসামিরা প্রচণ্ড শক্তিতে নির্মমভাবে আবরারকে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় ও লাথি-গুতো মারে। মেহেদী হাসান রবিন ও অনিক সরকার রুম থেকে বের হওয়ার সময় উপস্থিত আসামিদের বলে, ‘তোরা ওর কাছ থেকে তথ্য বের’। মনিরুজ্জামান মোবাইল চেক করে শিবিরের তথ্য পেয়েছে বলে আবরারকে স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করা শুরু করে।
অনিক সরকার ফের রুমে এসে দ্বিতীয় দফায় স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারের পিঠে, নিতম্বে, পায়ে, হাতেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড জোরে আরও ৪০/৫০ টি আঘাত করে। এক পর্যায়ে আবরার বমি ও প্রসাব করে দেয় এবং কাতরাতে কাতরাতে ইশারা-ইঙ্গিতে প্রাণে বাঁচার মিনতি করে। কিন্তু আসামিরা আবরারকে বাথরুমে নিয়ে পরিষ্কার করিয়ে জামা-কাপড় বদলিয়ে ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসানের হুকুমে নাজমুস সাদাত, শামীম বিল্লাহ, সামছুল আরেফিন রাফাত, আকাশ হোসেন, মোয়াজ আবু হোরায়রা, জেমি, এহতেশামুল রাব্বি আবরারের নিথর দেহ ধরাধরি করে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যায়। এর পর ইফতি মোশাররফ মেসবয় জাহিদ হাসান জনিকে ডেকে ২০১১ নম্বর রুমটি পরিষ্কার করায়।
আবরারকে মুমূর্ষু দেখেও আসামিরা বলে, নাটক করছে
২০০৫ নম্বর রুমে আবরারকে নেওয়ার পর ইফতি মোশাররফ আসামি নাজমুস সাদাত, এহতেশামুল রাব্বি, সামছুল আরেফিন, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ, আকাশ, জেমি মোর্শেদ অমর্ত্যকে বলে, ‘তোরা এবার আবরারের কাছ থেকে বের কর, বুয়েটে কে কে শিবির করে।’ আবরারকে মুমূর্ষু দেখে মোয়াজ, মোর্শেদ অমর্ত্য, মেহেদী হাসান রবিনকে জানায়, আবরারকে হাসপাতালে নিতে হবে। তখন মেহেদী হাসান বলে, ‘ও নাটক করছে, শিবির চেনস না, শিবির চেনা কষ্ট।’ গত ৭ অক্টোবর রাত আড়াইটার দিকে মোয়াজ, ইফতি মোশাররফ, মুজাহিদুল ইসলাম, মাজেদুর রহমান, তাবাককারুল ইসলাম ও তোহা প্রায় শেষ অবস্থার দিকে আবরারকে তোষকে করে নামিয়ে এক তলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিং স্থানে রাখে। এরই মধ্যে আবরার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিছুক্ষণ সাড়া শব্দ না দেখে আসামিরা আবরারকে হাসপাতালে পাঠাবে বলে বুয়েটের ডাক্তার ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনে। ডাক্তার এসে আবরারের দেহ পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করে।
চার্জশিটভুক্ত আসামিরা
মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেহেদী হাসান রবিন, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিওন, মুনতাসির আলম জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির, মো. মুজাহিদুর রহমান, মুহতাসিম ফুয়াদ, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুর রহমান, শামীম বিল্লাহ, মোয়াজ আবু হুরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত, ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, অমিত সাহা, মো. মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু। চার্জশিটভুক্ত পলাতক তিন আসামি হলেন- মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ ।
সারাবাংলা/এআই/পিটিএম