রায়ে সন্তুষ্ট, দ্রুত বাস্তবায়ন চান আবরারের মা
৮ ডিসেম্বর ২০২১ ২৩:১৬
কুষ্টিয়া: ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর। বুয়েট শেরেবাংলা হলের সিঁড়ির ল্যান্ডিং। সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছিল আবরার ফাহাদের নিথর মরদেহ। এরপর ক্যালেন্ডারের পাতায় পেরিয়ে গেছে দুই বছর দুই মাস। কিন্তু কুষ্টিয়ার পিটিআই রোডের সেই বাড়ির কান্না এখনো থামেনি। সন্তান হারানো পাগলপ্রায় মা-বাবা অপেক্ষায় ছিলেন কেবল ন্যায় বিচারের। সে অপেক্ষার পালা শেষ। বুধবার ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক ঘোষণা করলেন আবরার হত্যা মামলার রায়। ২০ আসামিকে দিয়েছেন মৃত্যুদণ্ড, পাঁচ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
সন্তান ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। তবু সান্ত্বনা, হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। তাই রায়ে সন্তুষ্ট আবরারের মা রোকেয়া খাতুন। জানিয়েছেন, এখন এই রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চান।
রায় ঘোষণার পর কুষ্টিয়ায় নিজ বাসায় প্রতিক্রিয়া জানান আবরারের মা রোকেয়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘যে রায় হয়েছে আমরা তাতে সন্তুষ্ট। অমিতসহ আরও চারজন আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছে। আমরা তাদের ব্যাপারেও উচ্চ আদালতে আবেদন করব। তাদেরও যেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাদের রায় দেওয়া হয়েছে তাদের রায় যেন অবিলম্বে কার্যকর করা হয় সেটিই আমার চাওয়া।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরকমভাবে কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয় সে আশাও প্রকাশ করেন আবরারের মা।
আবরারের পরিবারের দাবি ছিল, হত্যায় জড়িত ২৫ আসামিরই যেন ফাঁসি হয়। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তাতেও অখুশি নয় আবরারের পরিবার। এখন তাদের প্রার্থনা, ট্রাইব্যুনালের রায় যেন উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া তিন আসামি পলাতক। তাদের খুঁজে বের করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শাস্তির মুখোমুখি করবে— এটিই চাওয়া পরিবারের।
আবরারের ছোটভাই ফাইয়াজ বলেন, ‘আমরা চাইব উচ্চ আদালতেও যেন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এ রায় যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়।’
আবরারের ভাই আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মতো এরকম যেন কেউ আর মৃত্যুবরণ না করে। এ রায় কার্যকর হলে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়ে থাকবে।’
কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছিলেন আবরার। কলেজ ছিল নটরডেম। মেধার স্বাক্ষর রেখে ভর্তি হয়েছিলেন বুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর তাকে রুম থেকে ডেকে নেন ছাত্রলীগ নেতারা। রাতভর চলে নির্মম নির্যাতন। ভোরে পাওয়া যায় তার মরদেহ।
দেশব্যাপী আলোচিত সেই হত্যা মামলাতেই বুধবার ২০ আসামি পেলেন সর্বোচ্চ সাজা। আদালত বলছেন, এমন নির্মমতার শিকার যেন আর কাউকে হতে না হয়, সে কারণেই এমন দৃষ্টান্তমূলক সাজা।
অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। তড়িৎকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখছিলেন আবরার ফাহাদ। সেই আবরারকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সহপাঠীদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরপর দুই বছর ধরে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আদালত প্রাঙ্গণে ছুটেছেন বরকত উল্লাহ। দুই বছর দুই মাস পর এসে বিচারিক আদালত থেকে রায় পেলেন সেই হত্যা মামলার। রায় শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তিনি। অঝোরে কান্না ঝরে পড়ল বরকত উল্লাহর চোখ থেকে।
বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। এসময় আদালতে ২৫ আসামির মধ্যে ২২ জন উপস্থিত ছিলেন।
রায় ঘোষণার পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আদালতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। উচ্চ আদালতে যেন এই রায় বহাল থাকে।’
বরকত উল্লাহর চাওয়া— এই রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়। রায়ে সন্তুষ্ট বলেও জানান তিনি। তবে ছেলেকে হারানোর বেদনা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছেন না। তিনি বলেন, ছেলেকে তো ফিরে পাব না। এখন শুধু চাওয়া, রায় দ্রুত কার্যকর হোক। এই রায় থেকে সবাই শিক্ষা নিক। আমি ছেলে হারিয়েছি। আর কোনো বাবাকে যেন এভাবে সন্তান হারাতে না হয়— এটুকুই প্রত্যাশা থাকবে।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ভোরে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। ওই হলের ১০১১ নম্বর রুমে থাকতেন তিনি। হলের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রাতে শিবির সন্দেহে তাকে হলের ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে প্রাণ হারান আবরার ফাহাদ।
এ ঘটনায় প্রথমে বুয়েট প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। পরে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদ্ন্ত করে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান। এর মধ্যে ১৯ জন ছিলেন এজাহারভুক্ত আসামি, তদন্তে জড়িত প্রমাণ পাওয়ায় বাকি ছয় জনকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ২৫ আসামির মধ্যে ২২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রায় ঘোষণার সময় তাদের সবাইকে আদালতে হাজির করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ২০: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— মেহেদী হাসান রাসেল (২৪), মো. অনিক সরকার অরফে অপু (২২), মেহেদী হাসান রবিন অরফে শান্ত (২৩), ইফতি মোশাররফ সকাল (২০), মো. মনিরুজ্জামান মনির (২১), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (২৩), মো. মাজেদুর রহমান অরফে মাজেদ (২০), মো. মুজাহিদুর রহমান অরফে মুজাহিদ (২১), খন্দকার তাবাকারুল ইসলাম অরফে তানভির (২১), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (২১), মো. শামীম বিল্লাহ (২১), মো. সাদাত অরফে এ.এস.এম. নাজমুস সাদাত (২১), মুনতাসির আল জেমী (২০), মো. মিজানুর রহমান অরফে মিজান (২২), এস.এম. মাহমুদ সেতু (২৪), সামসুল আরেফিন রাফাত (২১), মো. মোর্শেদ অরফে মোর্শেদ অমত্য ইসলাম (২০), এহতেশামুল রাব্বি অরফে তানিম (২০), মোহাম্মদ মোর্শেদ উজ্জামান মণ্ডল প্রকাশ জিসান (২২) এবং মুজতবা রাফিদ (২১)। এর মধ্যে তানিম, প্রকাশ জিসান, রাফিদ পলাতক রয়েছে।
যাবজ্জীবন দণ্ড যাদের: যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— অমিত সাহা (২১), ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (২১), মো. আকাশ হোসেন (২১), মুহতাসিম ফুয়াদ (২৩), ও মো. মোয়াজ অরফে মোয়াজ আবু হুরায়রা (২১)।
এর আগে, গত ২৮ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। ওইদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়ে আগামী ৮ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন।
মামলাটিতে মোট ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে, ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান।
অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ১৯ জন। এছাড়া তদন্তে আরও ছয় জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিন জন পলাতক রয়েছে। তাদের মধ্যে আট জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
১২ বছর আবরারের পরিবারকে মাসিক ৭৫ হাজার টাকা দেবে বুয়েট
‘আবরার হত্যা মামলার রায়ে প্রমাণ— দেশে আইনের শাসন আছে’
‘আবরার হত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধেই সর্বোচ্চ সাজা’
আবরার হত্যাকাণ্ডের রায়ে সন্তুষ্ট বুয়েট উপাচার্য
রায় শুনে অঝোরে কাঁদলেন আবরারের বাবা
সারাবাংলা/একে