Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাপ্তাই লেকে মাছ স্বল্পতায় কমেছে শুঁটকির উৎপাদন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৮:২৯

রাঙ্গামাটি: ষাটের দশকে রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর থেকে এটি দেশের মৎস্য সম্পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কাঁচামাছের পাশাপাশি শুঁটকি উৎপাদন করেও জীবিকা নির্বাহ করছেন এখানকার জেলে-ব্যবসায়ীরা। তবে সংশ্লিষ্টদের হিসেবে কাপ্তাই হ্রদের মাছের শুঁটকি উৎপাদন দিন দিন কমছেই।

উৎপাদনকারীরা বলছেন, হ্রদে শুঁটকি তৈরিযোগ্য মাছের স্বল্পতা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জেলেদের দাদন প্রথা এবং মাছের দরবৃদ্ধির কারণে তারা শুঁটকি উৎপাদন কমে গেছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙ্গামাটি বিপণনকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিএফডিসি রাঙ্গামাটি অবতরণকেন্দ্রে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ৭৮৩ টন শুঁটকি অবতরণ করা হয়; যা ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩৩৯ টনে। সে হিসেবে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের চেয়েও বেশি।

এদিকে, শুঁটকির বাৎসরিক উৎপাদন হিসেব বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭২০ টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৩৯ টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৩৩ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৩৬ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৯৭ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০৯ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫৮ টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছে।

রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কাপ্তাই হ্রদবেষ্টিত থাকলেও শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে বিশেষত জেলার লংগদু ও বরকল উপজেলায়। বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নে এবং লংগদু উপজেলার কাট্টলী বিল, গাঁথাছড়া ও ঝর্ণাটিলা এলাকায়।

স্থানীয় শুঁটকি উৎপাদনকারীরা ১০-১৫ প্রজাতির মাছ হতে শুঁটকি উৎপাদন করেন থাকেন। এরমধ্যে কাঁচকি, চাপিলা, ছোট চিংড়ি, বড় চিংড়ি, মিশালি মাছ (একসঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ), শোল, টাকি, গজার, বাইম, আইড় মাছ অন্যতম। তবে উৎপাদিত শুঁটকির বেশিরভাগ তৈরি হয়ে থাকে কাঁচকি, চাপিলা ও মিশালি (বিভিন্ন প্রজাতি) মাছ থেকে।

বিজ্ঞাপন

লংগদু উপজেলার কাট্টলী বিলের মাঝখানে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কাট্টলী বাজারে দীর্ঘ এক যুগ ধরে শুঁটকি উৎপাদন করছেন স্থানীয় মো. ইলিয়াস হোসেন। একইবাজারে পেশাদার শুঁটকি উৎপাদনকারী রয়েছেন আরও ১২-১৫ জন।

ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আমি বিগত দশ বছর ধরে শুঁটকি উৎপাদন করে আসছি। আমার মতো এই এলাকায় অনেকেই পেশাদার শুঁটকি উৎপাদন করছেন। তবে দিন দিন মাছের দর বৃদ্ধি ও বাজারদর গরমিল, জেলেদের দাদন সিস্টেমের প্রভাবে অনেকেই শুঁটকি উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন।’

আরেক উৎপাদনকারী মো. শাহ আলম বলেন, ‘আমরা এখানে কাঁচা মাছ কিনে সেগুলো থেকে শুঁটকি উৎপাদন করে থাকি। মূলত ৪ কেজি কাঁচামাছ থেকে এক কেজি শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। যে কারণে মাছের তুলনায় শুঁটকির দাম অনেক বেশি। বাজারে শুঁটকির চাহিদা রয়েছে; কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক কারণে পর্যাপ্ত মাছ কেনার অভাবে শুঁটকি উৎপাদন করতে ব্যহত হচ্ছি।’

একই বাজারের লালু সরকার জানান, কাট্টলী বাজারে কাঁচকি, চাপিলা, মলা, শোল, চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। এরপর তৈরিকৃত শুঁটকি থেকে সরকারকে ৫৫ টাকা রাজস্ব, কোনো কোনো মাছে তারও অধিক রাজস্ব দিয়ে সেগুলো চট্টগ্রামে বিক্রয় করে থাকি। সেখান থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে; বিশেষয়ত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে শুঁটকি বাজারজাত করে থাকেন।

লালু বলেন, ‘রাঙ্গামাটিতে আগের মতো শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে না; তুলনামূলকভাবে উৎপাদন কমেছে। এর অন্যতম কারণ মাছের সংকট ও দামবৃদ্ধি।’

উৎপাদনকারীরা জানান, স্থানীয় জেলেরা জেলা শহরের মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে আগেই দাদন হিসেবে নগদ টাকা নিয়ে থাকেন। যে কারণে জেলেদের জালে যে পরিমাণ মাছ ধরা পড়ে; সেগুলো ব্যবসায়ীদের কাছেই পৌঁছাতে হয়। অনেক সময় জেলেদের খাওয়ার জন্য মাছ পর্যন্ত থাকে না। যে কারণেও আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ কিনতে পারছি না। অর্থনৈতিকভাবে যদি আরও সাবলম্বী হতাম, তাহলে আগে থেকেই জেলেদের সঙ্গে মাছের জন্য চুক্তি করা যেতো।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙ্গামাটি বিপণণকেন্দ্রের সহকারী মার্কেটিং অফিসার মো. শোয়েব সালেহীন জানান, রাঙ্গামাটির দুই উপজেলা- বরকল ও লংগদুতে শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে। এরমধ্যে বেশির ভাগই শুঁটকি উৎপাদন হয় কাট্টলী বিলের মাছ থেকে। কাপ্তাই হ্রদে কমবেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থাকলেও শুঁটকি উৎপাদন হয় প্রায় ১০-১৫ প্রজাতির মাছের। আর স্থানীয় চাহিদা কম থাকায় বেশিরভাগ বাজারজাতকরণ করা হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে।

তিনি আরও জানান, কাপ্তাই হ্রদ সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। মাছের পাশাপাশি বিএফডিসি এখানে শুঁটকি থেকে রাজস্ব আহরণ করে থাকে। আমরা কাঁচকি-চাপিলা মাছে ৫৫ শতাংশ, মিশালি, চিংড়ি ও ছোট চিংড়ি মাছে ৫০ শতাংশ এবং শোল, টাকি, গজার ও বাইম ও আইড়ের মাছে ৭৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে থাকি। তবে উৎপাদিত শুঁটকির বেশিরভাগই কাঁচকি, চাপিলা ও মিশালি মাছ।

উল্লেখ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়গুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। কাপ্তাই হ্রদের আয়তন বাংলাদেশের পুকুরগুলোর মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ ও অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। হ্রদকেন্দ্রিক মাছ ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে লক্ষাধিক মানুষ। এশিয়ার বৃহত্তম এ কৃত্রিম হ্রদ থেকে প্রতি বছরই মৎস্য সম্পদ হতে রাজস্ব আয় করছে সরকার।

সারাবাংলা/এসএসআর/এমও

কাপ্তাই লেক মৎস্য সম্পদ মাছ রাঙ্গামাটি শুটকি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর