সুগন্ধার বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ, তীরে স্বজনদের ভিড়
২৪ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:৪১
বরিশাল: শীতের রাত। সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে রওনা দিয়ে বরগুনার পথে এমভি অভিযান-১০। মধ্যরাত ৩টার দিকে লঞ্চটি পৌঁছে গেছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর গাবখান ধানসিঁড়ি এলাকায়। যাত্রীদের বেশিরভাগই ঘুমে। হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। ইঞ্জিন রুম ও রান্না ঘরে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। নিমেষে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা লঞ্চে। আগুনের লেলিহান শিখা একে একে পুড়িয়ে দেয় লঞ্চকে। দগ্ধ করে যাত্রীদের। হতচকিত অবস্থায় কেউ কেউ আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টায় লাফিয়ে পড়েন লঞ্চে থেকে।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে সুগন্ধা নদীর গাবখান ধানসিঁড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনার শিকার হয় এমভি অভিযান-১০। পরে দ্রুত দিয়াকুল এলাকায় নদীর তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানো ও উদ্ধারকাজ শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে লঞ্চের দেড় শতাধিক যাত্রী দগ্ধ হয়েছেন আগুনে। এর মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন, দগ্ধ বাকিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টার তথ্য বলছে, ফায়ার সার্ভিস ৩৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ওই লঞ্চ থেকে। মরদেহগুলোর নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। মরদেহগুলোর অবস্থা এমন যে বেশিরভাগই ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চজুড়ে কেবলই পোড়া শরীরের গন্ধ। পোড়া লাশের সে গন্ধ সুগন্ধা নদীর তীর ভারী করে তুলেছে।
আরও পড়ুন-
- লঞ্চে আগুন: ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি
- লঞ্চে ভয়াবহ আগুন: প্রাণহানি বেড়ে ৩৯
- লঞ্চ থেকে নদীতে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচালেন ইউএনও
- মাঝনদীতে লঞ্চে ভয়াবহ আগুন, ১৬ জনের লাশ উদ্ধার
- লঞ্চে আগুন: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর শোক, যাচ্ছেন ঝালকাঠি
- ঘুম ভেঙে কয়েকশ যাত্রী দেখলেন— মরতে হবে ডুবে, নয়তো আগুনে
লঞ্চে আগুন লাগার খবর পেয়ে সকাল থেকেই সুগন্ধা নদীর তীরে ভিড় জমাতে থাকেন ওই লঞ্চের যাত্রীদের স্বজনরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে থাকে। নদী তীরে ভিড় জমানো স্বজনদের অনেকেই জানেন না, তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে। পোড়া লাশের গন্ধের সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ তৈরি হয় দিয়াকুলে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুনে পোড়া মরদেহগুলোর বেশিরভাগই শনাক্ত করার অবস্থা নেই। অনেক মরদেহেরই হাড়গোড়ের সঙ্গে সামান্য কিছু মাংস অবশিষ্ট। ডিএনএ পরীক্ষা না করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। যারা দগ্ধ হয়েছেন, তাদের অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল (শেবাচিম) কলেজ হাসপাতাল ও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অনেকেও হয়তো আর বেঁচে উঠতে পারবেন না।
দিয়াকুলে নদীর তীরে ভিড়ে থাকা আগুনে পোড়া লঞ্চটিতে উঠে দেখা যায়, এমন কোনো অংশই নেই যেখানে আগুনের ভয়াবহতা পৌঁছেনি। কেবিনে থাকা যাত্রীরা সেখানেই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন। ঘুমের মধ্যেই তাদের জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহতা। একটি স্থানে কেবল দু’জনের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আগুন তাদের পুড়িয়ে অঙ্গার করে ফেলেছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানান, বিকট শব্দের পরপরই লঞ্চে আগুন ধরে যায়। লঞ্চের পেছনের অংশ থেকে তৃতীয় তলার সামনে পর্যন্ত আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতগতিতে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই লঞ্চ থেকে নদীতে লাফ দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছেন। অনেকেই হয়তো পারেননি।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, লঞ্চের ইঞ্জিনের পাশের রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। আবার ইঞ্জিনের বিস্ফোরণ থেকেও সূত্রপাত হতে পারে আগুনের। বিস্তারিত তদন্তের আগে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে অবশ্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার শহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ভোরে খবর পেয়েই ফায়ার সার্ভিস লঞ্চটির আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে যুগপৎভাবে চলতে থাকে উদ্ধার তৎপরতা। এখন পর্যন্ত ৩৯ জনের মরদেহ আমরা উদ্ধার করেছি। তবে নিহতদের নাম-পরিচয় কিছুই প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পারিনি।
শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি কোস্টগার্ড সদস্যরাও আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা ও ঝালকাঠির কোস্টগার্ড সদস্যরা কাজ করছেন।
সারাবাংলা/টিআর