‘খুনিকে আশ্রয় দিয়ে আমেরিকা মানবাধিকার-গণতন্ত্রের ছবক দেয়’
২৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:৩৫
ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মামলায় দণ্ডপ্রান্ত খুনিদের আশ্রয়দাতা আমেরিকার কাছ আমাদের আইনের শাসনের ছবক শুনতে হয়, মানবাধিকারে কথা শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথা শুনতে হয়, সেটিই খুব অবাক লাগে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকা, যারা সবসময় ন্যায় বিচারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে। এ পর্যন্ত আমেরিকার যতজন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন আমি সরকারে আসার পর তাদের প্রত্যেককে অনুরোধ করেছি বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত দিতে। তাদের জিজ্ঞাসা করেছি- একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনারা কীভাবে আশ্রয় দেন? আপনাদের জুডিশিয়ারি সিস্টেম কীভাবে আশ্রয় দেয়? কীভাবে আপনারা একজন খুনিকে আশ্রয় দেন? খুনি রাশেদ এখন আমেরিকায়। আর নূরকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে কানাডা। তারপরও তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের ছবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়! সেটিই আমার কাছে খুব অবাক লাগে।’
মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত মুজিববর্ষ স্মারক প্রকাশনা বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ এবং Bangabandhu and the Judiciary’ ও মুজিববর্ষ স্মরণিকা ন্যায় কণ্ঠ মোড়ক উন্মোচন ও প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যুক্ত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আইনের শাসন কায়েম হবে, আইনে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কি হয়েছিল? বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে। ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করার পর ইমডেমনিটি অর্ডিন্যান্স পাস হলো। ওই খুনিদের কোনোদিন বিচার করা যাবে না, ওই হত্যার মামলা করা যাবে না এমন অধ্যাদেশ দেওয়া হলো।’
১৫ আগস্টের ঘটনা কারবালার ঘটনাকেও হার মানিয়েছিল উল্লেখ করে এক রাতে নিজের পরিবারের সবাইকে হারিয়ে দুই বোনের বেঁচে থাকার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে খুনের পর যদিও প্রথমে ক্ষমতায় এসেছিল আমার বাবার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক। সেটি সংবিধান লঙ্ঘন করেই তার ক্ষমতা আরোহন। কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ও জিয়াউর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। জিয়াউর রহমানের প্ররোচনায় এই ঘটনা ঘটানো হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে যে ষড়যন্ত্রকারী ছিল, তা এখনও বের করা যায়নি। আশা করি একদিন সেটিও বের হবে।’
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসলে বেঈমান বা মোনাফেক যারা হয়, তাদেরকে অন্য মানুষ ব্যবহার করে, কিন্তু কখনো রাখে না। আসল যে থাকে, সে থাকে পর্দার আড়ালে। পলাশীর ঘটনাও যদি দেখি, তখনও মীরজাফর ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে মিশে ষড়যন্ত্র করে নবাব হওয়ার আশায়। সে কিন্তু তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আপনারাও একটু দেখবেন, খন্দকার মোশতাকও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। পর্দার আড়াল থেকে আসল লোক ক্ষমতা দখল করে চলে আসে, সেটি হলো জেনারেল জিয়াউর রহমান।’
সেনাপ্রধান হিসাবে জিয়ার ক্ষমতা দখল করে দল গঠন করাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আর্মি রুলস অ্যান্ড অ্যাক্টেও ছিল যে সেনাপ্রধান কখনো নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান এবং রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজেকে ঘোষণাই শুধু দেয়নি, এরপর গণভোট দিলো, হ্যাঁ-না ভোট দিলো। সেটির নামে একটা প্রহসন। তারপর আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করল এবং সেই নির্বাচন করেছিল সে তখন ঘোষিত রাষ্ট্রপতি প্লাস সেনাবাহিনী প্রধান। আমার প্রশ্ন গণতন্ত্রটা তাহলে কোথায়?’
‘আমাদের অনেকেই তার পেছনে খুব বাহবা দিয়ে নেমে পড়ল, হাতে তালি দিয়ে গণতন্ত্র পেয়েছে ? সেনাপ্রধান এবং ঘোষিত রাষ্ট্রপতি; আর্মি রুলস যেমন ব্রেক করল, সংবিধান লঙ্ঘন করল তারপর ইলেকশন মানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রহসন দিয়ে ক্ষমতায় এসে এরপরে দল গঠন করে জিয়াউর রহমান।’
‘দল গঠনের পর রাজনীতিবিদ হতে জিয়াউর রহমানের আর কোনো লজ্জা থাকল না। উর্দি খুলে তখন সেই দল গঠন। আর ক্ষমতায় উত্তরণ করে তারপরে তার রাজনীতিতে আসা, তারপর দল গঠন করলে আর দল গঠন করলে খুব স্বাভাবিকভাকে দল গঠন করতে গিয়ে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী, নির্বাচিত প্রতিনিধি যে-যেখানে ছিল একেবারে সেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে সবাইকে চাপ দিয়ে দিয়ে তার দলে ভেড়ানো শুরু করে। আর যে দলে না ভিড়বে তাকে ভোগ করতে হবে অত্যাচার নির্যাতন মিথ্যা মামলা। নির্যাতন করে করে অনেককে দলে ভেড়ানো হলো, কাউকে প্রলোভন দিয়ে, কেউ লোভে এলো, কেউ অত্যাচারিত হয়ে এলো, কেউ নির্যাতিত হয়ে এলো; এইভাবে দল গঠন। সেই দলটাই হচ্ছে বিএনপি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করল।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘সেখানে আবার শোনা গেল বহুদলীয় গণতন্ত্র? আর সেখানে নির্বাচনের সামনে প্রহসন। একটি দল জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলতে শিখল না, হাঁটতে শিখল না, এ-গাছের ছাল ও-গাছের বাকল দিয়ে একটি দল করে সেই দল আবার নির্বাচনে একেবারে টু থার্ড মেজরিটি (দুই তৃতীয়াংশ) পেয়ে যায়! অর্থ্যাৎ অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতাকে ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সেই ক্ষমতাকে কন্টকমুক্ত করার জন্য একটা প্রচেষ্টা।’
‘আর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দিয়ে খুনিদের বিচার না করা, বিচারহীনতার যে কালচার। আমরা কোনো একটা ঘটনা ঘটলে যেমন বিচারের জন্য যখন সকলে দাবি করে আমার তখন এটাই মনে হয়। আমরা যারা আপনজন হারিয়েছিলাম আমরা তো ৩৬ বছর সময় লেগেছিল বিচার পেতে। সেটিও যখন আমরা বেঁচে ছিলাম, জানি না আল্লাহর ইচ্ছা! ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলাম বলেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য আমরা আপিল করি। আমরা রিট করি, মামলা করা হয়, সে জন্য ধন্যবাদ জানাই উচ্চ আদালতকে। উচ্চ আদালত সেই জিনিসটা আমলনামায় নেন এবং সেটার ওপর এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটা বাতিল করেন। সে জন্য আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। যারা এই অর্ডিন্যান্স বাতিল করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাহলে মামলা করবার জন্য আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি, আমাদেরকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে।একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমার বিচার চাওয়ার অধিকার হরণ করা হয়েছিল। আমার মতো যারা সবাইকে হারিয়েছিলাম। তাহলে গণতান্ত্রিক অধিকারটা ছিল কোথায়? মৌলিক অধিকার কোথায় ছিল? মানুষের অধিকার কোথায় ছিল? আমি যদি বেঁচে না থাকতাম বা আর কোনদিন ক্ষমতায় আসতে না পারতাম তাহলে কোনদিন আর এই বিচার হত না। এটিই হলো বাস্তবতা। কোনোদিনেই বিচার হত না। কেউ ছিল না, সাহস করে করে। সেই ইনডেমনিটি অর্থ্যাৎ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে যেত। কিন্তু আমাদের সংবিধানে তো ন্যায় বিচার পাওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু সেই বিচার হয়নি, এটিই হলো বাস্তবতা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারে আসার পর বিচার হয়েছে। যদিও এই বিচারের রায় দিতে যেয়ে বা বিচার করতে যেয়ে অনেকেই উচ্চ আদালতে সেই সাহসটা পাননি, আমি জানি! একটা পর্যায়ে সরে গেছেন, কেন সেটা! তারপরও আমি বলব, এই বিচারের রায় আমরা পেয়েছি এই বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এখনও কয়েকজন রিফিউজিটিভে আছে তারা পালিয়ে আছে। তাদেরকেও খোঁজা হচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা আমেরিকার মত জায়গা, যারা সবসময় ন্যায়বিচারের কথা বলে। গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, তারা মানবাধিকারের কথা বলে; কিন্তু আমাদের যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল আমরা যে ন্যায়বিচার পাইনি, তারপর যখন এই বিচার হল সেই খুনিদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে। আমি সরকারে আসার পর থেকে বারবার যতজন রাষ্ট্রপতি এসেছে প্রত্যেকের কাছে বারবার অনুরোধ করেছি, একটা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনারা কিভাবে আশ্রয় দেন? আপনাদের জুডিশিয়ারি কিভাবে আশ্রয় দেয়? কিভাবে আপনারা একজন খুনিকে আশ্রয় দেন?’
‘যে খুনিটা ১৫ আগস্ট যখন আমার সেজো ফুফুর বাড়ি আক্রমণ করে সেইখানে যে গ্রুপটা যায়, তার কমান্ডিং অফিসার ছিল ওই রাশেদ। সেই খুনি এখন পর্যন্ত আমেরিকায়। তাকে আজকে পর্যন্ত কেউ’ই ফেরত দিল না। আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য কথা বলে আর খুনিদের আশ্রয় দেয়, প্রশয় দেয় কেন? আমি জানি না! তারা নাকি বিশ্বের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশ। আমি এতবার প্রত্যেক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছি। বারবার তাদেরকে অনুরোধ করেছি। আমরা বারবার চেষ্টা করেছি।’
কানাডায় মেজর নূর, সে ছিল ৩২ নম্বরে হত্যাকাণ্ডের জন্য কমান্ডিং অফিসার হিসাবে। আর ফারুক ছিল ট্যাংকের দায়িত্বে। আর নূর ঢুকেছিল সেই ছিল কমান্ডিং অফিসার । অথচ নূরকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে কানাডা। আর খুনি রাশেদ এখনো আমেরিকায়। তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের ছবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়! সেটিই আমার কাছে খুব অবাক লাগে?
সারাবাংলা/এনআর/একে