Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারতের বুকে যেন এক টুকরো বাংলাদেশ

আলতাফুর রহমান আলতাফ, ডি‌স্ট্রিক ক‌রেসপ‌ন্ডেন্ট
৫ জানুয়ারি ২০২২ ১৩:২৫

তিনবিঘা করিডোর, ছবি; সংগৃহীত

লালমনিরহাট: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেঘলিগঞ্জ মহকুমা ও দেশের লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে ঘেঁষে বহুল আলোচিত এক স্থানের নাম তিনবিঘা করিডোর। ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এ ভূমি, যা ভারতের মালিকানাধীন। তিনবিঘা জায়গার মধ্যে অবস্থিত। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যাতায়াতের সুবিধার্থে এটি বাংলাদেশকে ইজারায় দেয় ভারত। প্লাস (+) চিহ্ন রাস্তা দিয়ে দুই দেশের নাগরিকেরা চলাচল করে। এছাড়াও প্লাস চিহ্নের রাস্তার মাঝখানে দায়িত্ব পালন করে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ।

বিজ্ঞাপন

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এনক্লেইভ (রাষ্ট্রের যে অংশ অন্য রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত)। জানা গেছে, জেলার পাটগ্রাম উপজেলার তিনবিঘা করিডোরকে দেশের সাবেক ছিটমহলও বলা হয়েছিল । ১৮ দশমিক ৬১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই গ্রামে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশির বসবাস।

জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধী-শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশ তিন বিঘা করিডোর দক্ষিণ বেরুবাড়ীর সার্বভৌমত্ব পরস্পরের কাছে হস্তান্তর করে। যার আয়তন ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার বা ৫৮৪ ফুট দ্ধ ২৭৯ ফুট ও ৭ দশমিক ৩৯ বর্গ কিলোমিটার বা ২ দশমিক ৮৫ বর্গমাইল। এর ফলে উভয় দেশেই তাদের ছিটমহলে যথাক্রমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর যাতায়াত সুবিধা তৈরি হয়। এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। যদিও তিনবিঘা করিডোর রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেনি ভারত। কারণ এটি হস্তান্তরে ভারতের সাংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনেক বিরোধিতার পর ২০১১ সালে পূর্ণভাবে এটি বাংলাদেশকে দেওয়ার বদলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকারকে ইজারা হিসাবে দেয় ভারত।

ইজারার শর্ত ছিল, একই সময়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। ১২ নং দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের মোট আয়তন ২২ দশমিক ৫৮ বর্গকিলোমিটার (৮.৭২ বর্গমাইল)। যার ১১ দশমিক ২৯ বর্গকিলোমিটার (৪.৩৬ বর্গমাইল) পায় বাংলাদেশ। এছাড়াও পূর্বের ভাগ অনুসারে কোচবিহারের চারটি ছিটমহল বাংলাদেশে পড়েছিল। যার আয়তন ৬ দশমিক ৮৪ বর্গকিলোমিটার ( ২.৬৪ বর্গমাইল)। এভাবে মোট আয়তন দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ১৩ বর্গকিলোমিটার (৭.০০ বর্গমাইল)।

বিজ্ঞাপন

১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই ভূখণ্ডগুলোর মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ভারতে হস্তান্তরের কথাছিল। যার মোট আয়তন ১৮ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার (৭.২১ বর্গমাইল)। আর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল মুসলমান। যদি এই হস্তান্তর সফল হতো তাহলে এটি জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল। ফলে বেরুবাড়ীর জনগণ এই হস্তান্তর বিরোধিতা করেছিল। এরপর ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয় বেরুবাড়ীর অর্ধেক অংশ ভারতের অধীন থাকবে এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেই থাকবে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি তিন বিঘা আয়তনের জায়গা ইজারা হিসেবে দেয়। এটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং তিন বিঘার চারপাশে সতর্কতার সঙ্গে বেষ্টনীও দেওয়া হয়। যা ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিবর চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ১.১৪ ধারা অনুসারে বেরুবাড়ী বিরোধের অবসান ঘটে।

চুক্তি অনুসারে, ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণাংশের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করবে যার আনুমানিক আয়তন ৬ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার (২.৬৪ বর্গমাইল) এবং এর বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ। ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাসীদের বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার (৫৮৪ ফু দ্ধ ২৭৯ ফু) আয়তনের একটি ভূমি বাংলাদেশকে ইজারা হিসেবে দেবে।

তিনবিঘা নামের উৎপত্তিও বাংলা থেকেই। বাংলা আয়তন পরিমাপের একটি একক বিঘা থেকে তিনবিঘা নামের উৎপত্তি, ভূমির মোট আয়তন ১ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৭৭১ বর্গমিটার (১৬ হাজার ১৫০ থেকে ৭২ হাজার ৮৮০ বর্গফুট) যা তিনবিঘা পরিমাপের সমান। তিস্তা পাড়ের এই গ্রামের চারপাশেই হলো ভারতীয় ভুখণ্ড এবং বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে এই ছিটমহল প্রায় ২০০ মিটার দূরে। আর এই ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য আর ৮৫ মিটার প্রস্থের তিনবিঘা করিডোরই হচ্ছে দহগ্রামে যাবার একমাত্র পথ। আগে পূর্বে করিডোরটি দিনের ১২ ঘণ্টার সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হত। এতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হত। কারণ ওই সময় সেখানে কোনো হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সর্বশেষ ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশিদের যাতায়াতের জন্য তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা শুরু হয়। তখন থেকে বর্তমানেও ২৪ ঘণ্টা খোলে রাখা হচ্ছে।

দিনে দিনে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছে এই তিনবিঘা করিডোর। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোরটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সালের পূর্বে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাতে কোনো হাসপাতাল বা কলেজ ছিল না। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রামে একটি ১০ শয্যার হাসপাতাল ও দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের উদ্বোধন করেন। দহগ্রাম-আঙ্গরগপোতা গ্রামটি বেশি বড় নয়। তিস্তার ওপারেই ভারতীয় ভূখণ্ড দেখতে পাবেন। দুই দেশের মানুষই এখানে একই নদী ব্যবহার করছে শান্তিপুর্ণভাবে।

যেভাবে যাবেন: ঢাকা, রংপুর ও জেলা সদর লালমনিরহাট থেকে সরাসরি বাস যোগে পাটগ্রামে আসা যায়। এছাড়া ও রংপুর ও লালমনিরহাট থেকে প্রতিদিন ৫ টি ট্রেনে পাটগ্রামে আসা যায়। পাটগ্রাম সদর থেকে দহগ্রাম তিনবিঘা করিডোরের দুরত্ব ৯ কিলিমিটার। পাটগ্রাম থেকে সবসময়ে রিকশা বা টেম্পু যোগে তিনবিঘা করিডোরে যাওয়া আসা করা যায়।

সারাবাংলা/এনএস

তিনবিঘা করিডোর লালমনিরহাট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর