মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ
৮ জানুয়ারি ২০২২ ১৩:২২
ঢাকা: দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ১৫ শতাংশ। অথচ গত দুই বছর সড়কে অন্যান্য দুর্ঘটনা প্রায় সমান ছিল।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
শনিবার (৮ জানুয়ারি) সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। বক্তব্য রাখেন বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হামিদুজ্জামান ও রোড সেফটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান।
সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মোটরসাইকেলকে দায়ী করে সড়কে মোটরসাইকেল কমিয়ে আনার পরামর্শ দেওয়া হয় রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৩৭১টি। এর মধ্যে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৯২৭ জন নারী ও ৭৩৪ জন শিশু। আর ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২২১৪, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৫২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৯৮ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ সময়ে ৭৬টি নৌ–দুর্ঘটনায় ১৫৯ জন নিহত, ১৯২ আহত এবং ৪৭ জন নিখোঁজ রয়েছে। ঝালকাঠির সুগন্ধ্যা নদীতে ১টি লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫১ জন নিহত, ২৩ জন চিকিৎসাধীন এবং অজ্ঞাত সংখ্যক নিখোঁজ রয়েছে। এছাড়ার ঈদে ঘরমুখো যাত্রায় শিমুলিয়া–বাংলাবাজার ফেরি ঘাটে তাড়াহুড়া করে নামার সময় ৬ জন নিহত এবং ৩১ জন আহত হয়েছে। ১২৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছে।
প্রতিবেদেন আরও বলা হয়, দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়— মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২২১৪ জন (৩৫.২৩ শতাংশ), বাস যাত্রী ৩৮৯ জন (৬.১৯শতাংশ), ট্রাক–পিকআপ–কাভার্ডভ্যান–ট্রাক্টর–ট্রলির যাত্রী ৪৫৭ জন (৭.২৭ শতাংশ), মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার–এ্যাম্বুলেন্স–জিপের যাত্রী ২৭৬ জন (৪.৩৯ শতাংশ), থ্রি–হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক, সিএনজি, অটোরিকশা, অটোভ্যান, মিক, টেম্পু ও লেগুনা) ৯৩৪ জন (১৪.৮৬ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন,ভটভটি, আলমসাধু, পাখিভ্যান, চান্দের গাড়ি, বোরাক, মাহিন্দ্র ও টমটম) ৩৫৯ জন (৫.৭১ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল–প্যাডেল রিকশা রিকশাভ্যান–ঠ্যালাগাড়ি আরোহী ১৩২ জন (২.১০ শতাংশ) নিহত হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১৪টি (৩৮.৪৯ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৬৭০টি (৩১.০৯ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে ৯৫৪ টি (১৭.৭৬ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৬৬৫টি (১২.৩৮ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬৮টি (১.২৬ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাসমূহের ১০৫৭টি (১৯.৬৭ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮১৩টি (৩৩.৭৫ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৫৬৬টি (২৯.১৫ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৮২২টি (১৫.৩০ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১৩টি (২.১০ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
সংস্থাটি জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে দশমিক ৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আবার ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ১ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ এই তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান। মূলত ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০ এবং ২০২১ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬ দশকি ১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, জাপান নিজের দেশে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ আমাদের দেশকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র বানিয়েছে। পৃথিবীর সব দেশ এখন মোটরসাইকেল কমিয়ে আনছে। আমাদের দেশেও মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ।
তারা আরও বলেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছিল। গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণে ছিল। দীর্ঘ সময় কেটেছে লকডাউনে। তারপরও সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলেই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বৃদ্ধির পেছেনে অনেকগুলো কারণ কাজ করছে। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর ও যুবকরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদেরও আক্রান্ত করছে। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মোটরসাইকেল চালক সড়ক–মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্বায় পথচারী নিহতের ঘটনাও ঘটছে। মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে।
সংস্থাটি জানায়, দেশে ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০৭৮টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২২১৪ জন ও আহত ১৩০৯ জন। নিহতের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২১ দশমিক ১২ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, মোটরসাইকেলে ভারী যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৩ দশমিক ০৭ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে দশমিক ৫২ শতাংশ।
রোড সেফটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৪০ দশমিক ৭৬ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল চালক এককভাবে দায়ী ছিল। দুর্ঘটনার জন্য বাসের চালক দায়ী ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ, ট্রাক চালক দায়ী ২৮ দশমিক ০৫ শতাংশ, কাভার্ডভ্যান–পিকআপ–ট্রাক্টর–টুলি–বরি–ট্যাংকার চালক দায়ী ৯ শতাংশ, প্রাইভেটকার মাইক্রোবাস চালক দায়ী ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, থ্রি হুইলার ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং বাইসাইকেল, প্যাডেল রিকশা, রিকশালান চালক দায়ী দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং পথচারী দায়ী ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এদিকে, ৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে, ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে, ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ঘটেছে গ্রামীণ সড়কে এবং ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে শহরের সড়কে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এনএস