‘অনুমতি না দিলে মামলা দেয় না ক্যান?’
১৫ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:৫০
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ১১ দফা বিধিনিষেধে গণপরিবহনগুলো অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তবে বলা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট দফতর এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকরের দিন-তারিখ জানাবে। কিন্তু বিধিনিষেধ চলাকালে গণপরিবহনে বহন করার যাত্রীর সেই সংখ্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) শনিবার (১৫ জানুয়ারি) থেকে অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে বাস চলবে বলে নির্দেশনা দেয়। তবে বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) পরিবহন মালিক সমিতির প্রভাবশালী নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বিআরটিএ থেকে মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, ‘শনিবার থেকে সব আসনে যাত্রী পরিবহন করা হবে।’
কিন্তু বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘এমন কোনো সিদ্ধান্ত মালিক সমিতিকে দেওয়া হয়নি। বরং মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে, সেখান থেকে আসবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
এদিকে, শনিবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে শতভাগ যাত্রী নিয়েই বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজকে তো তারা মোবাইল কোর্ট চালাইছে। সেখানে তো কোনো মামলা দেয় নাই।’
আর সভা শেষে বিআরটিএ চেয়ারম্যান জানান, শনিবার (১৫ জানুয়ারি) থেকে বাসে অর্ধেক আসনে যাত্রী বহন করা হবে। তবে এর জন্য ভাড়া বাড়বে না। বুধবার অবশ্য বাসে সব আসনে যাত্রী বহনের অনুমতি চেয়ে একটি আবেদন করার কথা জানান পরিবহন মালিকরাও। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ যদি মৌখিক অনুমতি না দেয় তবে মামলা দেয় না ক্যান?
শনিবার (১৫ জানুয়ারি) রাজধানী বিভিন্ন স্থানে সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ প্রতিপালন হচ্ছে তা তদারকির জন্য রাজধানীসহ চট্টগ্রামে নয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিআরটিএ। সাতটি টিম রাজধানীতে ও চট্টগ্রামে দু’টি টিম এ অভিযান পরিচালনা করে।
রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল, মিরপুর, কল্যাণপুরসহ আশেপাশের এলাকায় মো. ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে ৮ নম্বর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রথমদিন আমরা স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। কিছু ক্ষেত্রে জরিমানাও করেছি। তবে আশা করছি সামনের দিনগুলোতে সবাই সচেতন হয়ে মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মানবে। আমরা যখন অভিযান চালাই তখন অনেকেই এটিকে সাধুবাদ জানিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই যাত্রীরা বিড়ম্বনা মনে করেছে। তবে তারাও স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিয়ে অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন।’
আরও পড়ুন:
- বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর ১১ দফা বিধিনিষেধ
- গণপরিবহনে অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহন নিয়ে সিদ্ধান্ত বুধবার
- মাস্ক না পরলে জরিমানাসহ ১১ দফা বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপন জারি
- অর্ধেক নাকি সব আসনে যাত্রী— বিআরটিএ-মালিক সমিতি মুখোমুখি
রাজধানী শাহবাগ, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের দিকে আয়েশা আক্তারের নেতৃত্বে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পরিচালনা করা হয়। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আমরা যেখানেই ব্যত্যয় দেখেছি সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছি। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে এটি আরও উন্নত হবে। তবে দূরপাল্লার যে গাড়িগুলো ছিল সেগুলোতে তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি যাত্রীরা অনেকেই মেনেছে। কিন্তু নগর পরিবহন সেটা কম দেখা যাচ্ছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো ফলাফল দেখতে পাব।’
তবে দুই ম্যাজিস্ট্রেটই জানান, সব আসনে যাত্রী পরিবহনের বিষয়টি জানিয়ে কোনো নির্দেশনা তাদের বিআরটিএ থেকে দেওয়া হয়নি। এর আগে, ১২ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুধবার বিআরটিএ’র সঙ্গে বৈঠকে সব আসনে যাত্রী বহনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাতে সবুজ সংকেত পেয়েছি। সব আসনে যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে আমাদের মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা আসনের সমান যাত্রী বহন করতে পারব। এই মৌখিক নির্দেশনা আমরা সব পরিবহন মালিকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।’
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এই নেতার দাবির সঙ্গে অবশ্য দ্বি-মত প্রকাশ করেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। মৌখিক কোনো নির্দেশনার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৈঠকে অনেক বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্তগুলো গতকালই জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেগুলোই সিদ্ধান্ত। এর বাইরে কিছু নেই।’
তিনি বলেন, ‘সব আসনে যাত্রী পরিবহনের একটি প্রস্তাব মালিকরা আমাদের দিয়েছেন। তারা বলছেন, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গাড়ি চললে সংকট হবে। রাতারাতি গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো সম্ভবও না। আমরা বৈঠকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে তাদের এই প্রস্তাবনার কথাও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছি। বাকি বিবেচনা তাদের। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে কোনো ধরনের আদেশ পাইনি।’ মৌখিক নির্দেশনার বিষয়ে নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘মৌখিক নির্দেশনা বলে কিছু নেই। সরকারিভাবে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে সেটিই সবাইকে বাস্তবায়ন করতে হবে।’
তবে শনিবার (১৫ জানুয়ারি) গণপরিবহনে সকল আসনে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সারাদেশে সব প্রতিষ্ঠান খোলা। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, বাণিজ্যমেলা, নির্বাচনসহ সবকিছুই হচ্ছে। কিন্তু গাড়ির যাত্রীই অর্ধেক নিয়ে চলতে হবে কেন? যখন স্বাভাবিক নিয়মে গাড়ি চলে তখনই তো সকালে সাধারণ মানুষ গাড়ি না পেয়ে ভাংচুর করে। এমন অবস্থায় যদি যাত্রী রাস্তায় গাড়ি না পায় তবে তার দায় কে নেবে?’
মোবাইল কোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মৌখিক নির্দেশনা আমরা পেয়েছি শতভাগ যাত্রী নিয়ে গাড়ি চালানোর বিষয়ে। এক্ষেত্রে আজ অনেক জায়গায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে জরিমানা করা হয়েছে। তবে যাত্রীর বিষয়ে কোনো জরিমানার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্ধেক যাত্রী নিয়ে পরিবহন চালানোর কথা সড়কে। বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলছেন শতভাগ যাত্রী নিয়ে গাড়ি চালানোর বিষয়ে তিনি কোনো মৌখিক নির্দেশনা দেননি। তাহলে সরকারের নির্দেশনা উপক্ষা করে শতভাগ যাত্রী নিয়ে সড়কে গাড়ি চালানো কি আইনসম্মত? এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসমান আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ তো নয়টা মোবাইল কোর্ট চালাইছে। জরিমানাও করছে অনেক জায়গায়। যদি বিআরটিএ চেয়ারম্যান মৌখিক নির্দেশনা না দিয়ে থাকে তবে আজকে মোবাইল কোর্টে একটা জায়গায়ও জরিমানা করে নাই ক্যান? অনুমতি না দিলে মামলা দেয় না ক্যান?’
এর আগে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে গত ১০ জানুয়ারি ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ট্রেন-বাস ও লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী নিতে হবে। সব যানের চালক ও সহকারীদের অবশ্যই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সনদধারী হতে হবে। সংশ্লিষ্ট দফতর এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করতে বলে জানানো হয়। এরপর রেল কর্তৃপক্ষ শনিবার থেকে অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। লঞ্চ মালিকরাও বলেছেন, তারা অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করবেন, তবে ভাড়া বাড়াবেন না। তবে বাস বিষয়ে এখন পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত তা কাগজে কলমে এক রকমের হলেও বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে ভিন্ন।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম