Thursday 05 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তৃণমূলের সম্মেলন: ‘একক কর্তৃত্বে’র লাগাম টানল কেন্দ্র

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৬ জানুয়ারি ২০২২ ২২:১৯ | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:১৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: তৃণমূলের সম্মেলন নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনে ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে ‘সমঝোতা বৈঠক’ হয়েছে। এরই মধ্যে সম্পন্ন হওয়া ইউনিট সম্মেলন এবং দলের সদস্যপদ পাওয়া এবং বাদ দেওয়া নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো পর্যালোচনার জন্য ছয় সদস্যের একটি রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে কেন্দ্রের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া রিভিউ কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক থানার জন্য নগর কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে একটি করে টিম গঠনের জন্য বলা হয়েছে, যারা থানা ও ওয়ার্ডে সম্মেলন আদৌ সম্ভব কি না, সেটি খতিয়ে দেখবে। রিভিউ কমিটির কার্যক্রম এবং থানাভিত্তিক কমিটি গঠন হওয়ার পর তৃণমূলে সম্মেলনের ফের উদ্যোগ শুরু হবে। যদি রিভিউ কমিটি ব্যর্থ হয় এবং থানাভিত্তিক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হয় সেক্ষেত্রে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিষয়টি দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করবেন। তখন সভানেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বৈঠকে উপস্থিত নেতারা একমত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৬ জানুয়ারি) ঢাকার ধানমন্ডিতে সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সকাল ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

সভায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, অর্থ সম্পাদক ওয়াসেকা আয়শা খান, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহ-সভাপতি নঈমউদ্দিন চৌধুরী, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও বদিউল আলম এবং সাংসদ এম এ লতিফ ছিলেন।

সভার সিদ্ধান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবুল আলম হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের ছয় জন নেতাকে দিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছি। উনারা বসে এরই মধ্যে যেসব ইউনিটের কাউন্সিল হয়ে গেছে, সেগুলোতে কোনো অসঙ্গতি হয়েছে কি না, যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো রিভিউ করবেন। ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ প্রতিবেদন কেন্দ্রে আমাদের কাছে পাঠাবেন। এছাড়া প্রতিটি থানার জন্য নগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলদের নিয়ে ছোট আকারের একটি করে টিম করার কথা বলা হয়েছে। এই টিমের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট থানার ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলনগুলো হবে। সাত দিনের মধ্যে এই টিম করতে হবে। রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজন মনে হলে আমরা দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাছে গিয়ে বিষয়গুলো অবহিত করব এবং নির্দেশনা চাইব।’

গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ। প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি করে ইউনিট আছে। এরই মধ্যে ১২০টিরও বেশি ইউনিটের সম্মেলন শেষ হয়েছে। তবে কয়েকটি ইউনিটে পাল্টাপাল্টি সম্মেলন হয়েছে। আবার কয়েকটি গোলযোগের কারণে স্থগিত করতে হয়েছে। ইউনিটের পাশাপাশি গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে ওয়ার্ড সম্মেলন শুরুর কথা ছিল। কিন্তু ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্র থেকে গত ২৩ ডিসেম্বর ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।

তৃণমূলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে পরস্পরবিরোধী দু’টি ধারার বিরোধ আরও জোরালো হয়। দু’টি ধারার একটির নেতৃত্বে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন আছেন। আরেকটি ধারা প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিউদ্দিনপুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তাদের সঙ্গে আছেন।

ইউনিট সম্মেলনের শুরু থেকেই মহিউদ্দিনের অনুসারীরা অভিযোগ করে আসছিলেন, মাহতাব-নাছিরের একক কর্তৃত্ব ও ইচ্ছায় তৃণমূলে সম্মেলন হচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিটে মহিউদ্দিন অনুসারী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কৌশলে সদস্য করা হয়নি। তাদের বাদ দিয়েই সম্মেলন করে এক নেতার অনুসারীদের মাধ্যমে কমিটি করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া ওয়ার্ড ও ইউনিট সম্মেলনের আগে সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্য নগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি তথ্য বিবরণী ফরম সরবরাহ করা হয়। সেটি নিয়েও আপত্তি তোলেন নগর আওয়ামী লীগের নেতারা।

এ অবস্থায় তৃণমূলের সম্মেলনে অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ছয় নেতার সম্মিলিত রিভিউ বোর্ড গঠনের মধ্য দিয়ে মাহতাব-নাছিরের একক কর্তৃত্ব খর্ব করা হল বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, ছয় সদস্যের রিভিউ বোর্ডের প্রধান করা হয়েছে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, নঈমউদ্দিন চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দীন, জহিরুল আলম দোভাষ ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আগামী শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) রিভিউ কমিটির নেতারা চট্টগ্রামে প্রথম বৈঠক করবেন।

সভায় উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরোধী হিসেবে পরিচিত ধারার নেতারা প্রত্যেকে সভায় বক্তব্য দিয়ে ইউনিট সম্মেলনে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। আ জ ম নাছির উদ্দীন অবশ্য বিভিন্ন অভিযোগ খণ্ডন করেন। তবে পাল্টাপাল্টি বা উত্তেজনামূলক কোনো পরিস্থিতি সভায় হয়নি। সবাই প্রবীণ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন বলে একমত হন।

জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিভিউ কমিটি করা হয়েছে। উনাদের (চট্টগ্রামের নেতারা) বলেছি, অভিযোগ-অসঙ্গতি যা যা আছে সেগুলো পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন পাঠাও। পারলে নিজেরাই নিষ্পত্তি করো। আমরা সহযোগিতা দেবো। এরপর ওয়ার্ড সম্মেলন যেগুলো বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সময় আবার তারা পারলে ঠিক করবে। নয়তো কেন্দ্র থেকে ঠিক করে দেওয়া হবে। সেগুলোর জন্যও আলাদা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুব সুন্দরভাবে সভা হয়েছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কথা বলেছেন। একদম সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ ছিল। একটি কমিটি করে আমাকে প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রিভিউ করে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে ১৫ দিনের মধ্যে। এছাড়া নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির নেতাদের নিয়ে ১৬ থানায় ১৬টি ছোট কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেটিও আমরাই বসে দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেবো। আর আমরা যদি ব্যর্থ হই, তাহলে কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন— বিষয়টি উনারা প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে নিয়ে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেভাবে হবে।’

গত ২২ ডিসেম্বর মাহতাব-নাছিরের বিরোধী বলয়ের চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ্য নেতারা ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে গিয়ে ইউনিট সম্মেলন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ করেন। এরপরই কেন্দ্রীয় নেতারা ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। অভিযোগ জানানো নেতারা চট্টগ্রামে কয়েক দফা বৈঠক করে তাদের করণীয় নির্ধারণ করেন। কেন্দ্রীয় নেতারা ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এসে সংকট নিরসনে সভা করার কথা বললেও পরবর্তীতে সেটা বাতিল করে নেতাদের ঢাকায় ডেকে পাঠান।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ টপ নিউজ মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর