Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনে ১২ জনের দায় পেয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২২ জানুয়ারি ২০২২ ১৬:২৮

ঢাকা: এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ও হতাহতের ঘটনায় বিআইডব্লিউটির কর্মকর্তা, লঞ্চের মালিক, চালকসহ ১২ জনের দায় পেয়েছে দুর্ঘটনার পর এ উদ্দেশ্য গঠিত নাগরিক তদন্ত কমিটি।

শনিবার (২২ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক তদন্ত কমিটির (ছায়া তদন্ত কমিটি) প্রতিবেদন এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খানকে আহ্বায়ক, নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল বাবুলকে সদস্য সচিব এবং নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে এর সমন্বয়ে গঠিত ১৯ সদস্য বিশিষ্ট নাগরিক তদন্ত কমিটি (ছায়া তদন্ত কমিটি) এ প্রতিবেদন দাখিল করে।

অনুষ্ঠানে নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবু নাসের খান বলেন, ‘লঞ্চ পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূরীকরণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি এবং লঞ্চ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

এ ছাড়া এই দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে নাগরিক তদন্ত কমিটি

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে নাগরিক তদন্ত কমিটি

নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডে ও হতাহতের জন্য দায়ীদের সম্পর্কে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, এমডি অভিযান-১০ লঞ্চটি সর্বশেষ গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে চলার পর প্রায় ৩ (তিন) মাস চলাচল করেনি। এরপর ১৯ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা করে। সর্বশেষ ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পথে অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়। কিন্তু সার্ভের মেয়াদ ও রুট পারমিট বহাল থাকা সত্ত্বেও একটি যাত্রীবাহী নৌযানের চলাচল কেন এতদিন বন্ধ ছিল, সে বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক (নৌনিট্রা) বিভাগ ও নৌ পরিবহন অধিদস্তরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা খোঁজখবর নেননি এবং সংশ্লিষ্ট শিল্প সার্ভেয়ারকে জানাননি। এ ছাড়া সদরঘাট টার্মিনালে অফিস হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ারও বিষয়টি জানার চেষ্টা করেননি। এ ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব পালনে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

সুতরাং নাগরিক তদন্ত কমিটি মনে করে বিআইডব্লিউটিএর নৌনিট্টা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদিন ও পরিবহন পরিদর্শক দীনেশ দাস এবং ঢাকা নদীবন্দরে দায়িত্বরত নৌ পরিবহন অধিদফতরের পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমান ও একই অধিদফতরের ঢাকা (সদরঘাট) কার্যালয়ের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক (শিপ সার্ভেয়ার) মো. মাহবুবুর রশীদ দায়ী।

নাগরিক তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে— নৌ পরিবহন অধিদফতর থেকে ১৫ ডিসেম্বর ইস্যুকৃত নিবন্ধন সনদে এমভি অভিযান-১০ লক্ষে প্রতিটি ১১০০ ব্রিটিশ অশ্বশক্তি সম্পন্ন (বিএইচপি) দুটি চায়না ডিজেল ইঞ্জিন থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, লঞ্চটির দুটো ইঞ্জিন-ই ডাইহাটসু ডিজেল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, ওসাকা, জাপানের তৈরি ডিজেল ইঞ্জিন’; যার প্রতিটি ৩০৩৬ ব্রিটিশ অশ্বশক্তি সম্পন্ন (বিএইচপি)।

লঞ্চমালিকগণ সার্ভে সনদের শর্ত লঙ্ঘন করে নৌ পরিবহন অধিদফতরের অনুমতি ছাড়াই দুটো পুরানা ইঞ্জিন সংযোজন করেছেন। যে কোনো নৌযানে ১১২০ কিলোওয়াট বা ১৫০১.৯২ বিএইচপি’র ওপরের ইঞ্জিন পরিচালনার জন্য ইনল্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ার (আইএমই) নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে এমন সনদধারী কোনো ইঞ্জিন ড্রাইভার ছিলেন না। এমনকি পরিবর্তিত ইঞ্জিন দুটি ওই লঞ্চের জন্য উপযুক্ত কি না, তাও উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করানো হয়নি।

উপরিউক্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্যরা এই মর্মে একমত হন যে— এ সব বেআইনি কার্যকলাপের জন্য নৌযানটির চারজন মালিক দায়ী।

বিজ্ঞাপন

প্রসঙ্গত, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের (সরকারি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বর্ণনা তুলে ধরে নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— এমডি অভিযান-১০ লঞ্চটি চাঁদপুর ঘাট অতিক্রম করার পর ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়, অস্বাভাবিক শব্দ হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীগণ বলেছেন। ইঞ্জিনের ত্রুটি সারাতে ব্যর্থ হওয়ায় লঞ্চটি আর না চালিয়ে নিরাপদ কোনো ঘাটে আগেই ভেড়ানো উচিত ছিল। অনেক যাত্রী লঞ্চ ভিড়ানোর অনুরোধও করেছিল। কিন্তু লঞ্চের মাস্টার ও ইঞ্জিন ড্রাইভার এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে লঞ্চটি চালিয়ে যেতে থাকে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।

তাদের ভাষ্যমতে, সেদিন লঞ্চটির ইঞ্জিনের শব্দ অন্য দিনের মতো ছিল না। ইঞ্জিনকক্ষ ও আশপাশের এলাকা প্রচণ্ড গরম হয়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে আগুন ধরে যায়। এতে অর্ধশত মানুষের প্রাণহানির তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। সুতরাং নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্যরা একমত হন যে, অত্যন্ত বেদনাদায়ক এ ঘটনার জন্য লঞ্চটির প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার ও দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার মো. খলিলুর রহমান এবং প্রথম শ্রেণির ড্রাইভার মো. মাসুম বিল্লাহ ও দ্বিতীয় শ্রেণির ড্রাইভার আবুল কালাম দায়ী।

এসব বিষয়ে নাগরিক তদন্ত কমিটির ২৫ দফা সুপারিশ পেশ করে।

সুপারিশের মধ্যে রয়েছে: এমডি অভিযান-১০ লঞ্চ ট্র্যাজেডির জন্য শুধু মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারের শান্তি নয়; দায়ী সকলকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দুর্ঘটনায় নিহত পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন, টাকার পরিমাণ নির্ধারণ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী (নৌযান মালিক/মাস্টার/ড্রাইভার/সরকারি কর্মকর্তা) ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে হবে।

প্রত্যেক যাত্রীবাহী নৌযানে আনসার/সিকিউরিটি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষ, প্রবেশপথ, মাস্টারব্রিজসহ স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। যে কোনো নৌযানের নকশায় অগ্নি-নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত, সে অনুযায়ী নকশায় অনুমোদন এবং যথাযথভাবে নকশা অনুসরণ করে নৌযান নির্মাণ করতে হবে। নতুন নৌযানে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে ফায়ার সার্ভিস বিভাগের ছাড়পত্র গ্রহণ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক প্রতি তিন মাস পরপর তা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে।

চলমান নৌযানগুলো বিশেষ করে লঞ্চ ও অন্যান্য যাত্রীবাহী নৌযানের অগ্নি-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কি না, তা আগামী ছয় মাসের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষের পাশ থেকে খাবারের হোটেল সরিয়ে নিতে হবে এবং ইঞ্জিনকক্ষ ও ক্যান্টিনের (হোটেল) আশেপাশে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের দাহ্য পদার্থ রাখা নিষিদ্ধ করতে হবে।

নৌযানের ইঞ্জিনকক্ষে আগুন লাগলে তা দ্রুত নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সরবরাহ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএসহ সকল সরকারি দপ্তরের নৌযানসমূহকে হালনাগাদ সার্ভের আওতায় আনা ও নৌ অধীনস্থ সংস্থাগুলো থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের কথাও সুপারিশমালায় তুলে ধরা হয়েছে।

নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আমিনুর রসুল বাবুল, নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রধান সমন্বয়ক এবং নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে এবং সাবেক প্রধান নৌপ্রকৌশলী আবদুল হামিদ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী, জাকির হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গত ২৪ ডিসেম্বর শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে ঝালকাঠি নদীবন্দরের কাছে সুগন্ধা নদীর নদীর উত্তরপাড় দিয়াযুল এলাকায় যাত্রীভর্তি ‘এমডি অভিযান-১০ লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। লঞ্চটি ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা নদীবারের সদরঘাট টার্মিনাল থেকে যাত্রী বোঝাই করে বরগুনা যাচ্ছিল। অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন অর্ধশত মানুষ। লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন। এ ছাড়া শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ইনস্টিটিউ এবং বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনেকে চিকিৎসাধীন।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭ (সাত) সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তবে এ ঘটনার জন্য প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত, নিহত ও আহত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশবান্ধয় নৌ চলাচল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারি তদন্ত কমিটির পাশাপাশি বেসরকারি ১৬ সংগঠনের ১৯ জন প্রতিনিধিদের একটি ছায়া তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

ওই কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে দুর্ঘটনার জন্য ১২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে। একই সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধে ২৫ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

আরও পড়ুন
লঞ্চে আগুন: বরগুনায় গণকবরে ৩০ জনকে দাফন
লঞ্চে আগুন: লাশের খোঁজে নদীতে স্বজনরা
ইঞ্জিন থেকে লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত: তদন্ত কমিটি
লঞ্চে আগুন: নানীর মৃত্যুর খবরে বাড়িতে, ফেরার পথে হারালেন মেয়েকে
লঞ্চে আগুন: ২ তদন্ত দলের পরিদর্শনের পর অভিযান-১০ জব্দ
লঞ্চে আগুন: ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ
লঞ্চে আগুনে নিহতদের ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে রিট
সুগন্ধায় লঞ্চে আগুনের ঘটনায় এখনও নিখোঁজ ২৬ যাত্রী
লঞ্চে আগুন: দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ওএসডি

 

সারাবাংলা/কেআইএফ/একে

এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ লঞ্চে আগুন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর