সপ্তাহ পেরোলেও মিলছে না নমুনা পরীক্ষার ফল
৩১ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:৪১
ঢাকা: রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রাজীব চৌধুরী (ছদ্ম নাম)। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) উপসর্গ থাকায় ১১ জানুয়ারি জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে ব্র্যাক বুথে নমুনা জমা দেন আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য। রাতেই তাকে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হওয়ার তথ্য জানানো হয় এসএমএস পাঠিয়ে। কাজে যোগ দিতে কোভিড নেগেটিভ সনদ প্রয়োজন হওয়ায় তিনি ২২ জানুয়ারি নমুনা দেন একই কেন্দ্রে। তবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্তও তিনি এবারের নমুনা পরীক্ষার কোনো ফল জানতে পারেননি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটেও তার মোবাইল নম্বরের বিপরীতে নমুনা পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়নি।
৩১ জানুয়ারি মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার রায় ঘোষণার তারিখ থাকায় কক্সবাজারে যাওয়ার কথা ছিল গণমাধ্যমকর্মী রাশেদ ইসলামের। তবে করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকায় ২৮ জানুয়ারি নমুনা জমা দেন রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) থাকা ব্র্যাক বুথে। ৩১ জানুয়ারি রাত পর্যন্তও তিনি নমুনা পরীক্ষার ফল পাননি।
রাজীব চৌধুরী আর রাশেদুল ইসলামই নয়, নমুনা পরীক্ষা দিয়ে দিনের পর দিন এভাবে ফল না পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন অনেকেই। কেউ বলছেন, নমুনা দেওয়ার সাত দিন পরও ফল পাচ্ছেন না। কেউ কেউ বলছেন আরও বেশি সময়ের কথা। নমুনা পরীক্ষা দিয়েও ফল না পাওয়ায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।
তারা বলছেন, প্রথম নমুনা পরীক্ষার ফল না পাওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। ফলে চিকিৎসকরাও চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকছেন। অন্যদিকে যারা দ্বিতীয় নমুনা পরীক্ষার ফলের অপেক্ষা করছেন, তারা কর্মক্ষেত্রসহ সব জায়গাতেই প্রতিবন্ধকতর মুখে পড়ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহযোগিতায় ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোভিড-১৯-এর নমুনা সংগ্রহ করার জন্য রয়েছে বুথ। এসব বুথ থেকে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনাগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে। সেসব নমুনা পরীক্ষার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) সহযোগিতায় নমুনাদাতা ব্যক্তির মোবাইল নম্বরে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটেও সেই ফল আপলোড করা হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ল্যাবরেটরিগুলোতেও। নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা কোভিড-১৯ সংক্রমিত হওয়ায় নমুনা পরীক্ষাও পর্যাপ্ত পরিমাণে হচ্ছে না। পরীক্ষার জন্য ১২ থেকে ১৫ হাজার নমুনা জমে গেছে বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে। এ কারণে দেশে প্রতিদিন কোভিড-১৯ সংক্রমণের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে মূলত যাচ্ছে তিন থেকে চার দিন আগের তথ্য যোগ হচ্ছে। ফলে সংক্রমণের সঠিক তথ্যও জানা যাচ্ছে না।
কেবল ল্যাবরেটরি না, নমুনা পরীক্ষার পরে ফলাফল জানানোর দায়িত্ব যে এমআইএস বিভাগের, সেখানেও কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে সংক্রমণের সংখ্যা। আর সে কারণেই বেশ কয়েকদিন আগের নমুনা পরীক্ষার ফলও নমুনাদাতাদের জানানো সম্ভব হয়নি। সেই তথ্য আপলোড হয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাইটেও।
ব্র্যাক বুথের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর অনুমোদিত বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ব্র্যাক এ ক্ষেত্রে কেবল নমুনা সংগ্রহের কাজে সরকারকে সহযোগিতা করে থাকে। ফলে নমুনা পরীক্ষা ও ফল জানানোর ক্ষেত্রে ব্র্যাকের কোনো ভূমিকা নেই। তারা কেবল অ্যান্টিজেন টেস্টের ক্ষেত্রেই নমুনাদাতাকে ফল জানিয়ে থাকে।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক ডা. মোরশেদা চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, আমরা নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন ল্যাবে পৌঁছে দেই। আমাদের কাছে নমুনা সংরক্ষণের সুযোগই নেই। ফলে প্রতিদিন বিকেল ৪টার মধ্যেই ল্যাবগুলোতে নমুনা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার আমরা একেকটি বুথের জন্য বরাদ্দ করা নমুনার চেয়ে বেশি নমুনা সংগ্রহও করি না। এরপর নমুনা পরীক্ষা বা ফল জানানোর বিষয়টি পুরোটাই দেখে ল্যাব ও স্বাস্থ্য অধিদফতর।
ডা. মোরশেদা বলেন, আমাদের কাছেও অনেকে নমুনা পরীক্ষার ফল জানতে চায়। কিন্তু আমাদের সেটি বলার সুযোগ নেই। নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পৌঁছে দেওয়ার পর এখানে আমাদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্র্যাকের একটি বুথের একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, অনেকেই নমুনা দিয়ে আমাদের কাছে ফল জানতে চান। কিন্তু নমুনা ল্যাবে দেওয়ার পর আমাদের আর কোনো কাজ নেই। তারপরও আমরা কিছু যোগাযোগ করে জানতে পারছি, অনেক ল্যাবের অনেক কর্মীই এখন করোনায় আক্রান্ত। ফলে নমুনা পরীক্ষা সঠিক সময়ে হচ্ছে না। আজও (সোমবার, ৩১ জানুয়ারি) গত ২৮ জানুয়ারি সংগ্রহ করা নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে বলে শুনতে পেরেছি। এমআইএস বিভাগের অনেকেও করোনায় আক্রান্ত বলে শুনছি। ফলে নমুনা পরীক্ষা হলেও ফল জানানো বা আপলোডে দেরি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, অনেকে সংক্রমিত থাকার পরে যখন রিপোর্ট পাচ্ছেন তখন তিনি সংক্রমণমুক্ত হয়ে গেছেন।
দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নমুনা পরীক্ষার কৃতিত্ব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের। কিন্তু দেশে সংক্রমণ বাড়ার প্রভাব পড়েছে এই ল্যাবের কার্যক্রমেও। প্রতিষ্ঠানটিতে নমুনা পরীক্ষায় সংযুক্ত ব্যক্তিদের পাশাপাশি এখানে থাকা এমআইএস কর্মকর্তাদের মধ্যেও ছড়িয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, নমুনা পরীক্ষার ফলাফল জানানোর জন্য এমআইএস বিভাগের ১৭ জন কাজ করে থাকেন। তাদের জানুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহের শুরুর দিকে তাদের ১২ জনের মধ্যেই করোনা সংক্রমণ দেখা গেছে। এরপরই মূলত এখানে নমুনা পরীক্ষা করা হলেও এসএমএস বা সরকারি সাইটে ফল জানাতে বা আপলোড করতে দেরি হচ্ছে।
প্রায় একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ আক্রান্ত আরও সাত থেকে আট জন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. এহসানুল হকও কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে আছেন।
অধ্যাপক ডা. এহসানুল সারাবাংলাকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত। তারপরও আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি নমুনা পরীক্ষা করে ফল সঠিক সময়ে পৌঁছে দিতে। কিছুটা দেরি হলেও আমরা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। দেশে যখন সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে, তার প্রভাব সব ল্যাবেও পড়াটাও স্বাভাবিক। তবু আমরা দ্রুত সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরও নমুনা পরীক্ষা ও ফল জানানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে বিভিন্ন ল্যাবের কর্মকর্তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিকে কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন।
ডা. আহমেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ার প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাতেও। বিভিন্ন ল্যাবরেটরিসহ হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে। তাই নমুনা পরীক্ষা ও ফল জানাতে কিছুটা সমস্যা হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। তবে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও চলছে। আশা করছি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব সমস্যা সমাধান করে ফেলা সম্ভব হবে।
এদিকে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ জানিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। রোববার (৩০ জানুয়ারি) রাজধানীর মহাখালীতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) অডিটোরিয়াম মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিন এখন ১০-১৫ হাজার করে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তের হার বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ গুণ। আমার ধারণা, আমাদের দেশে হয়তো আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি। কারণ সবাই পরীক্ষা করে না।
করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলেও বিকল্প পরিকল্পনা না থাকা নিয়েই অভিযোগ প্রতিবেদনের শুরুতেই দ্বিতীয় নমুনা পরীক্ষার ফলের জন্য ৯ দিন ধরে অপেক্ষায় থাকা রাজীব চৌধুরীর। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সবাই নমুনা পরীক্ষা করে না— এটি পুরোপুরি সঠিকও না। আমি নমুনা পরীক্ষা করিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফল পাইনি। ল্যাবে অনেকেই আক্রান্ত হতে পারে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য কোনো বিকল্প পরিকল্পনা না থাকা তো যৌক্তিক হতে পারে না। ৯ দিন যদি ফল না জানানো হয়, তবে কতদিন ঘরে বসে থাকতে হবে? যারা নমুনা দিয়ে ৯ দিনেও ফল পাচ্ছেন না, তাদের এই ভোগান্তির দায় কে নেবে?
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা ব্র্যাক বুথ স্বাস্থ্য অধিদফতর