জানুয়ারি মাসে এক দিনের জন্যও নির্মল বাতাস পায়নি ঢাকাবাসী
১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:১৭
ঢাকা: ক্রমাগত খারাপ হতে থাকা বায়ু পরিস্থিতি দিয়ে শুরু হয়েছে ঢাকাবাসীর নতুন বছর। সদ্য বিদায়ী জানুয়ারি এক দিনের জন্যও নির্মল বায়ু সেবন করতে পারেনি তারা। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষক সংস্থা একিউএয়ারের তথ্য বলছে, এ মাসে এক দিনের জন্যও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে নামেনি ঢাকার বায়ু। বরং বেশ কয়েকদিনই ঢাকার বায়ুমান ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে।
শীত মৌসুমে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এমনিতেই বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাছাড়া ঢাকায় একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় দূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।
রাস্তা ও নির্মাণকাজের ধুলাবালির সঙ্গে আবার যুক্ত হয় ঢাকার আশপাশের সিমেন্ট কারখানা থেকে নির্গত ফ্লাই অ্যাশ ও ইটভাটার ধুলা। সব মিলিয়ে গেল বছরের ডিসেম্বর থেকেই খারাপ হতে থাকা বায়ু পরিস্থিতি জানুয়ারি মাসে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়। এ মাসের তিন ভাগের এক ভাগ সময়ই বায়ুমান ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর (একিউআই ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে)। বাকি দিনগুলোতে এই মান ছিল অস্বাস্থকর (একিউআই ১৫০ থেকে ২০০-এর মধ্যে) পর্যায়ে।
আরও পড়ুন-
- বায়ু দূষণে টানা শীর্ষে ঢাকা
- বায়ু দূষণ: টানা ৩ দিন শীর্ষে ঢাকা
- বায়ু পরিস্থিতি বিপজ্জনক হলেও উদাসীন সরকার
- এক বছরেই বায়ু দূষণ বেড়েছে ১০ শতাংশ: গবেষণা
- এক মাস ধরেই জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার বায়ু
- বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকা, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি: তাপস
- ঢাকায় নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে সবচেয়ে বেশি দূষণ
- অবৈধ চারকোল কারখানায় দূষিত পরিবেশ, রোগাক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
বায়ু মানের ক্ষেত্রে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক তথা একিউআইয়ের মান ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত থাকলে সেটিতে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে একিউএয়ার। এই মান ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত চরম অস্বাস্থ্যকর। একিউআই ৩০০-এর বেশি হলে সেটিকে বিপর্যয়কর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
একিউএয়ারের তথ্য বলছে, গত ৫ জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ১৫৭ একিউআই সূচকে পৌঁছালেও ১৮ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৬ দিন এই মান ছিল ২০০-এর কাছাকাছি। এর মধ্যে ২২ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ২৭৯-তে পৌঁছায়। এরপর ২৪ জানুয়ারি বৃষ্টি শুরু হলে ঢাকার একিউআই-ও কিছুটা কমে আসে। তারপরও এই বায়ু মান ১৭০-এর নিচে নামেনি। অর্থাৎ বৃষ্টি সত্ত্বেও ঢাকার বায়ুমান স্বাস্থ্যকর অবস্থায় ফিরে আসেনি এক দিনের জন্যও।
এদিকে, ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বায়ু পর্যবেক্ষণ হিসাব বলছে, ২৬ জানুয়ারি সব রেকর্ড ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে ঢাকার বায়ুমান। বায়ু দূষণ পরিমাপক সংস্থা এইকিউ এয়ারের দূষণ সূচক ৩০০ ছাড়ালেই যেখানে পরিস্থিতকে বিপর্যয়কর ধরা হয়, সেখানে এদিন ঢাকার বায়ুতে এই সূচক ৪৫৬ পর্যন্ত উঠে যায়।
বায়ুমানের ক্ষেত্রে কেবল একিউআই নয়, বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) তথা ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির দিক থেকেও জানুয়ারি মাসে ঢাকার ছিল অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। পিএম২.৫ হলো ২ দশমিক ৫০ মাইক্রনের চেয়ে ছোট যেসব বস্তুকণা যেগুলো ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। ফলে এসব ক্ষুদ্র কণা ফুসফুস তথা শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। একিউএয়ারের তথ্য বলছে, বাতাসে এই পিএম ২.৫-এর উপস্থিতির দিক থেকেও এই এক মাসের কোনো একটি দিনও স্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল না ঢাকার বাতাস।
পিএম২.৫ অর্থাৎ ২.৫ মাইক্রনের চেয়ে ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির মানেও গত ২২ জানুয়ারি ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। এদিন এর মান ২২৯-এ পৌঁছে যায়। মাসের বাকি দিনগুলোতেও এই মান কখনোই স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। বরং জানুয়ারি মাসের ১০ দিনই বাতাসে পিএম২.৫-এর উপস্থিতির মাত্রা ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর। বাকি ২০ দিনেও বাতাসে এসব ধূলিকণার উপস্থিতি ছিল অস্বাস্থ্যকর মাত্রায়।
একিউআই তথা বায়ুমান সূচকের মতো ১৮ জানুয়ারি থেকে টানা ছয় দিন ঢাকার বায়ুতে পিএম২.৫-এর উপস্থিতি ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর মাত্রায়। পরে বৃষ্টির প্রভাবে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি বাতাসে পিএম২.৫-এর মান একশ’র নিচে নামে। তবে সেটিও স্বাস্থ্যকর নয়। শুধু তাই নয়, মাসের শেষ দিন ৩১ জানুয়ারি এই মান ২০০ ছাড়িয়ে যায়, যা এই মাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের শুষ্ক এই মৌসুমে এমনিতেই বাতাসে ধুলাবালির প্রকোপ বেশি থাকে। কিন্তু বায়ুমানের গত এক মাসের পরিস্থিতি রাজধানীবাসীর জন্য ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি এই অস্বাস্থ্যকর বায়ুমানের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুদীপ রঞ্জন দেব সারাবাংলাকে বলেন, টানা অস্বাস্থ্যকর বাতাসের মধ্যে থাকলে মানুষের শরীরে দুই ধরনের প্রভাব দেখা দিতে পারে— তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি।
তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক প্রভাবের শিকার হয় সাধারণত শিশুরা। শিশুদের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ হতে পারে, যার প্রভাবে কাশি বা শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিতে পারে, যার প্রভাবে হাত-পা-ত্বকের রঙ কালচে নীল হয়ে যেতে পারে অনেকসময়।
দীর্ঘ মেয়াদে প্রাপ্তবয়স্করা বায়ু দূষণের শিকার হতে পারেন জানিয়ে ডা. সুদীপ বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে তারা শ্বসনতন্ত্রের নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগতে পারেন। বাতাসে থাকা ধুলা ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসে আটকে যায়। এতে ফুসফুসে লাং ফাইব্রসিস (শক্ত হয়ে যাওয়া) দেখা দিতে পারে। এটি অনিরাময়যোগ্য ব্যধি, যার ফলে ধীরে ধীরে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর