চট্টগ্রামে মেট্রোরেল ‘মাটির নিচ দিয়ে’ করার প্রস্তাব
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:১৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম শহরের মূল অংশে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলপথ (পাতাল রেল) নির্মাণের মত এসেছে মেট্রোরেলের সমীক্ষা নিয়ে আয়োজিত এক সভায়। একইসঙ্গে মেট্রোরেলের রুটের সঙ্গে মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেলের দক্ষিণপ্রান্ত এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সংযুক্ত করার প্রস্তাবনাও দিয়েছেন সভায় উপস্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা।
মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিবহন মাস্টারপ্ল্যানসহ মেট্রোরেলের সমীক্ষার জন্য প্রিলিমিনারি সার্ভে কাজ’ সংক্রান্ত এ মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি এক বছরের মধ্যে প্রাক সমীক্ষার কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে চট্টগ্রামে মেট্রো রেলপথের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেন, এমন প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেকে) বৈঠকে ঢাকার পর চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম নগরীতে পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ও মেট্রোরেল বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে।
আর প্রাক সমীক্ষা করছে কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কয়কা)। সংস্থাটির বাংলাদেশে নিযুক্ত উপ-পরিচালক খিম তে হিয়নের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সভায় উপস্থিত ছিলেন।
প্রাক সমীক্ষার কাজ মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পাওয়া সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেট্রোরেলের জন্য আজ (মঙ্গলবার) থেকেই ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু হল। কোরিয়ান টিম ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামে অবস্থান করে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সঙ্গে কথা বলবে। তারা আনুষাঙ্গিক সব তথ্য নেবে। পরবর্তীতে আরেকটি চূড়ান্ত টিম এসে আবার স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলবে। তারপর তারা আমাদের একটা স্টাডি রিপোর্ট দেবে। সরকারের নির্দেশনা হচ্ছে, এক বছরের মধ্যে যেন স্টাডি রিপোর্টটা তারা দেয়।’
সমীক্ষার জন্য ৭৭ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোরিয়া সরকার ৫১ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি ২৬ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে। সমীক্ষা শেষ করে আমরা বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো নিয়ে আসব।’
কয়কার ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর খিম তে হিয়ন জানিয়েছেন, প্রাথমিক সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে তারা মতবিনিময় করবেন। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। প্রাক সমীক্ষায় ১৮ মাসের মতো সময় লাগবে বলে তাদের ধারণা।
সভায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে প্রায় এক কোটি লোক বসবাস করে। ২০৩১ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম শহরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পুরো চট্টগ্রাম শহর কিন্তু অত্যন্ত জনবহুল। চকবাজার-বহদ্দারহাট এলাকাসহ শহরের ভেতরে অনেক এলাকাতেই সড়কের ওপরে মেট্রোরেল করার উপযোগিতা এখন আর নেই। সুতরাং একটি সমন্বিত পরিকল্পনা হতে হবে। আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল করার কথা ভাবতে হবে। এতে তিনগুণ খরচ বেশি হবে। তারপরও আন্ডারগ্রাউন্ডে মেট্রোরেল নিয়ে যাবার পরিকল্পনাটাই করলে আমার মনে হয় ভালো হবে।’
মেট্রোরেলের রুট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু টানেল, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত একটা রুট বলেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাও বলেছিলেন, সেখানে ট্রেন যায়, সুতরাং মেট্রোরেলও যেতে পারে। আরেকটি কথা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরকে মাথায় রাখতে। আরেকটি বিষয় আমি বলব, কর্ণফুলী নদীতে এ বছরের শেষ নাগাদ টানেলের উদ্বোধন হবে। টানেলের ও পাড়ে কিভাবে মেট্রোরেল নিয়ে যাওয়া যায়, এই জিনিসগুলো মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।’
পাঁচটি সরকারি সংস্থা— চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), চট্টগ্রাম বন্দর, ওয়াসা এবং রেলওয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে বসে তাদের মতামত নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান করার তাগিদ দেন মন্ত্রী। এছাড়া এক বছরের মধ্যে প্রাক সমীক্ষার কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক বছরের মধ্যে প্রাক সমীক্ষা শেষ করে আমরা যাতে দ্রুত কাজে নেমে যেতে পারি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে এক বছর পরে মেট্রোরেল কনস্ট্রাকশনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেন, সেই টার্গেট নিয়ে কাজ করতে হবে। এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ এ বছরের মধ্যে প্রাক সমীক্ষা শেষ করে আগামী বছরের শুরুতে যেন প্রধানমন্ত্রী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারেন, সেভাবে কাজ করতে হবে।’
মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পর নানা প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে— এমন ইঙ্গিত দিয়ে মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের ছোট দেশ, জায়গার মাল্টিপল ব্যবহার করতে হবে। একই জায়গা ওয়াসা ব্যবহার করবে, রেলও ব্যবহার করবে, দেশের প্রয়োজনে অন্য সংস্থাও ব্যবহার করবে। আমার জায়গা আমি কাউকে ব্যবহার করতে দেব না, এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। মেট্রোরেল করার সময় এ ধরনের অনেক ইস্যু আসবে, কিন্তু এ মানসিকতা নিয়ে যেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা না হয়।’
‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন, চট্টগ্রামের মানুষও ভাবেনি এখানে মেট্রোরেল হবে, চট্টগ্রামের মানুষের কোনো দাবিও ছিল না। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, সেজন্য তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করি, দ্রুততার সাথে কাজ হবে।’
প্রাক সমীক্ষার জন্য ৫১ কোটি টাকা অফেরতযোগ্য হিসেবে দেওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া সরকারকে ধন্যবাদ জানান তথ্যমন্ত্রী।
সভায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষই মূলত পাতাল রেলপথে মেট্রোরেল চলাচলের প্রস্তাব দেন। পরে এতে সায় দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও।
সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় আছে, নদী আছে, সমুদ্রও আছে— এই ভৌগলিক অবস্থানটা মাথায় রেখে মেট্রোরেলের পরিকল্পনা করতে হবে। এটাকে যদি আন্ডারগ্রাউন্ড করা হয়, তাহলে সুবিধা হবে। সড়কের ওপর হলে চাপ আরও বাড়বে। নিচে হলে ওপরের অর্ধেক মানুষ নিচে চলে যাবে। এতে শহরের ওপর চাপ কমবে।’
মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের মূল যে অংশ, চকবাজার, বহদ্দারহাট এরকম আরও অনেক এলাকায় এখন সড়কের ওপর দিয়ে মেট্রোরেল নিয়ে যাওয়াটা কঠিন হবে। হয়ত সম্ভব হবে না। বহদ্দারহাটের পর কালুরঘাট দিয়ে হয়ত সড়কের ওপর দিয়ে মেট্রোরেল যেতে পারবে, কিন্তু বহদ্দারহাট থেকে চকবাজার হয়ে শহরের দিকে হতে পারবে না। এ কারণে এটা আন্ডারগ্রাউন্ড হলে বেশি উপকার হবে।’
মেট্রোরেলের কাজ শুরুর পর জনভোগান্তি যাতে বেশি না হয়, বিষয়টি প্রাক সমীক্ষার ক্ষেত্রেও মাথায় রাখা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন মেয়র।
মেয়রের পাশাপাশি জনভোগান্তির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার তাগিদ দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। জলাবদ্ধতা আছে। এরপর মেট্রোরেলের কাজ শুরু হলে শহরের ট্রাফিক পরিস্থিতি কি হবে, সেটা একটু ভেবে দেখে সুচিন্তিত এবং সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। ট্রাফিক সিস্টেমটা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এমন পরিকল্পনা নেওয়া উচিৎ। সামগ্রিক বিষয়ে দুইদিনের একটা ওয়ার্কশপ হলে ভালো হয়।’
মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ করার জন্য যেসব বিদেশি নাগরিক আসবেন, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সিএমপি কমিশনার বলেন, ‘চট্টগ্রামে অনেক মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে। সেখানে অনেক বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার একটা বিষয় আছে, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয়হীনতা আছে। তাদের কাছ থেকে প্রস্তাবগুলো আসে খুবই বিক্ষিপ্তভাবে, এতে নিরাপত্তার পরিকল্পনা বিঘ্নিত হয়। ট্রাফিক সিস্টেম এবং সিকিউরিটি— এই দু’টি বিষয় মাথায় রাখতে হবে এবং এখন থেকেই সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।’
এছাড়া মেট্রোরেল চালুর পর সংশ্লিষ্ট রুটে নিরাপত্তার পরিকল্পনাও এখন থেকেই শুরু করার তাগিদ দেন সিএমপি কমিশনার।
এদিকে মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, মহেশখালী মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, বে টার্মিনাল, চট্টগ্রাম বন্দর, সকল বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে মেট্রোরেলের নেটওয়ার্কের মধ্যে আনার প্রস্তাব দেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান। এছাড়া মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোর বহুমুখী ব্যবহার অর্থাৎ স্টেশনের সঙ্গে শপিংমল, হাসপাতাল ও বিনোদন কেন্দ্র রাখার প্রস্তাব দেন তিনি।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রস্তাব দেন, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, ইপিজেড, বন্দর, কাস্টম, আগ্রাবাদ, নিউমার্কেট মোড়, খাতুনগঞ্জ, অক্সিজেন মোড়, শাহ আমানত সেতু, কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকাকে মেট্রোরেলের আওতায় আনার জন্য। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় স্টেশন করার প্রস্তাব দেন তিনি।
চসিকের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন মেট্রোরেলের রুট কক্সবাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া এবং তিন পার্বত্য জেলাকেও সংযুক্ত করার বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দেন।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মালেক, যুগ্ম সচিব মাহবুবুর রহমান বক্তব্য রাখেন।
সভা শেষে মেট্রোরেলের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এখানে সড়ক আছে, ফ্লাইওভার আছে, আন্ডারপাস-ওভারপাস আছে, ব্রিজ আছে, টানেল আছে— এসবগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে জনগণের চলাচলকে সহজ করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। চট্টগ্রাম শহরে জনসমাবেশ আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে অনেক বেড়ে যাবে। এজন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। চট্টগ্রামকে বাসযোগ্য রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।’
সারাবাংলা/আরডি/এনএস