জলবায়ুকে প্রাধান্য দিয়ে গড়া স্থাপনায় বিশ্বজয়
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:২৮
সাতক্ষীরা: যুক্তরাজ্যভিত্তিক রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টসের (রিবা) বিচারে সেরা স্থাপত্যের স্বীকৃতি পেয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সোয়ালিয়া গ্রামে অবস্থিত ‘শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল’। সাতক্ষীরার এই এলাকাটি অত্যন্ত লবণাক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও এই এলাকায় অনেক বেশি। হাসপাতালটির নকশা প্রণয়নে জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব মোকাবিলাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। আর তাতেই মিলেছে বিশ্বসেরা স্থাপনার স্বীকৃতি।
গত ২৬ জানুয়ারি রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা) আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২১ সালের সেরা স্থাপনা হিসেবে শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের নাম ঘোষণা করে। এর আগে, গত বছরের ১৬ নভেম্বর জার্মানের জেমস-সায়মন গ্যালারি ও ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের লিলে ল্যাঞ্জেব্রো সেতুর সঙ্গে সেরা তিন স্থাপত্যের তালিকায় জায়গা করে নেয় সুন্দরবন ঘেঁষা উপকূলপাড়ে স্বল্প খরচে গড়ে তোলা নয়নাভিরাম স্থাপত্যশৈলীর হাসপাতালটি।
উপজেলার সোয়ালিয়া গ্রামে প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই একর জমির ওপর আধুনিক যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রেখে নির্মাণ করা হয়েছে হাসপাতালটি। সুনিপুণ নকশা আর অনন্য স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয় ঘটিয়ে ২০টি ভবনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। স্থানীয় প্রযুক্তি ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে নির্মিত প্রায় ৪৮ হাজার বর্গফুটের ব্যতিক্রমী নকশার এ স্থাপনা তিন পাশে পানিবেষ্টিত।
পরিবেশ বিপর্যয় রোধে গোটা স্থাপনার যাবতীয় বর্জ্য তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংসে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসটিপি’র ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সীমানা প্রাচীরের পরিবর্তে ভবনগুলোর মধ্যভাগ ও পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে জলাধার, যা নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে।
স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ৮০ শয্যার এ হাসপাতালের নকশা তৈরি করেছেন। নকশা তৈরির সময় বাতাসের গতিপথ বিবেচনায় হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো অবস্থান নির্ধারণ করেন তিনি। এর আগে, এই স্থপতির নকশা করা গাইবান্ধার আরবানা ভবনটিও আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল।
সরজমিন পরির্দশনে দেখা যায়, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর সামনের দিকে রাখা হয়েছে উন্মুক্ত বিস্তর ফাঁকা জায়গা। তীব্র লবণাক্ততার বিষয় বিবেচনায় পলেস্তারা ছাড়া দেয়াল ও ছাদে শুধুমাত্র ইটের গাঁথুনি আর ঢালাইয়ের উপস্থিতি গোটা স্থাপনাটিকে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে। স্থাপনাজুড়ে বিভিন্ন পয়েন্টে সামঞ্জস্য রেখে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তাকে মূল নকশার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। তিন পাশে ঘিরে থাকা লবণ পানির উপস্থিতির জন্য স্থাপনার মধ্যে লবণাক্ত পানি শোধনে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তাছাড়া ভবনগুলোর মাঝখানের জলাধারে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সুযোগও রয়েছে।
স্থাপনার চতুর্পাশ ঘুরে দেখা যায়, মনোরম স্থাপত্যশৈলীর এই হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জায়গার স্বল্পতার কথা বিবেচনায় নিয়ে সীমানা প্রাচীরের পরিবর্তে বিভিন্ন অংশে ১০ ফুট প্রশস্ত জলাধারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে এখানে। হাসপাতালটিতে আউটডোর ও ইনডোর চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি সুপরিসর করিডোরসহ অডিটোরিয়াম, কনভেনশন সেন্টার, ক্যান্টিন আর প্রার্থনা কক্ষেরও উপস্থিতি রয়েছে।
সমগ্র স্থাপনার একাধিক অংশে ইট ও কাঁচের সমন্বয়ে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাসহ প্রশস্ত দরজা-জানালার উপস্থিতি গোটা স্থাপত্যে বাড়তি নান্দনিকতা যোগ করেছে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে সুপরিসর করিডোর আর বিস্তর প্রাকৃতিক আলো বাতাসের উপস্থিতি স্থাপত্যশৈলীকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ভবনগুলোর তলদেশ দিয়ে আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি পাশের কল্যাণপুর খালের মাধ্যমে মাদার নদীতে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা এহসানুল হক রোকন সারাবাংলাকে বলেন, শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ২০১৪ সালে এ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার পর ওই বছরেই উপকূলীয় জনপদের সেবাপ্রত্যাশীদের চিকিৎসাসেবা শুরু হয়। মূল স্থাপনার মধ্যে পাঁচটি ভবন আবাসিক, ১৫টি স্বাস্থ্যসেবার কাজে ব্যবহৃত হয়। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন সুবিধাকে এ স্থাপনার বিশেষত্ব বলে জানান তিনি।
হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক শাহিনুর রহমান বলেন, ছয় জন চিকিৎসক ও ১২ জন সেবিকাসহ সাহায্যকারী জনবলের মাধ্যমে সেখানে ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগে সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় প্রতি মাসে দেশের বাইরে থেকে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে এসে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। স্বল্প খরচে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা রয়েছে। এলাকার বাইরের রোগীর হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেও তিনি নিশ্চিত করেন।
স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অন্যতম শ্যামনগর। সেখানে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রেখে একটি হাসপাতালের নকশা তৈরির সময় স্বল্প বাজেটের কথা বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থার পাশাপাশি সর্বোচ্চ আধুনিকতার ছোঁয়া এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের কথা মাথায় রেখেই এ স্থাপনার নকশা তৈরি করা হয়েছে।
হাসপাতলটির সহকারী ব্যবস্থাপক অসীম ত্রিস্টোফার রোজারিও বলেন, একাধিক অপারেশন থিয়েটার ও নিউনেটাল কেয়ার ইউনিটে ইনকিউবেটর সুবিধাসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। স্থাপনাটি যেমন মনোরম, আমরা এখানে একইরকম উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে বদ্ধপরিকর।
সারাবাংলা/টিআর
যুক্তরাজ্য রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টসের (রিবা) শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল সাতক্ষীরা