ঋতু বিদায় নিলেও, শীতের বিদায় ফেব্রুয়ারির শেষে
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:১১
ঢাকা: শীতের চাদর মুড়ি দিয়েই বিদায় নিচ্ছে মাঘ। আর একদিন বাদেই পহেলা ফাল্গুন অর্থাৎ বসন্তের শুরু। ওই অর্থে কাগজে-কলমে শীতেরও বিদায়। কিন্তু এখনো শীতে মোড়ানো দেশের উত্তরাঞ্চল। পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। এর পরে রয়েছে ফের বৃষ্টির সম্ভাবনা। তারপর আবার তাপমাত্রা কমবে। এভাবেই চলতে চলতে ফেব্রুয়ারির শেষে বিদায় নেবে শীত— এমন আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্য বছরগুলোর চেয়ে এবারের শীত মৌসুম ছিল অনেকটাই ব্যতিক্রম। কারণ, এবার শীতের মধ্যেই বঙ্গোপসাগর ছিল উত্তপ্ত। আর বাড়তি তাপের কারণে ফুটন্ত পানির ধোঁয়ার মতো ঘন মেঘ তৈরি হয়েছিল। উপকূল থেকে আসা উষ্ণ মেঘ আর উত্তরের হিমেল হাওয়া এবার শীতের তীব্রতা বাড়িয়েছে। যার রেশ ছিল পুরো মৌসুম জুড়েই। আবহাওয়াবিদদের মতে, এই পরিস্থিতিকে বলে দ্বি-মেরু। যার প্রভাবে এবার শৈত্যপ্রবাহ বেশি ছিল। পাশাপাশি ছিল বৃষ্টি ও সাগরে লঘুচাপ।
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জোর্তিবিদ্যা অনুযায়ী, উত্তর গোলার্ধে ২১ ডিসেম্বর শীত মৌসুমের প্রথম দিন। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যনুযায়ী, বঙ্গাব্দের পৌষ ও মাঘ (নভেম্বর থেকে জানুয়ারি) শীত মৌসুম। যদিও দেশের উত্তরাঞ্চলে অক্টোবর থেকেই শীত অনুভূত হয়। এবার বড়ধরনের শৈত্যপ্রবাহ ডিসেম্বরের শেষে এলেও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাতটির মতো মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমেছিল।
যদিও আবহাওয়া অধিদফতরের মতে, তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে সেটাকে মৃদু শৈত্য প্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা যদি থাকে ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকে তাহলে সেটাকে বলা হয় মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে সেটাকে বলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। দুদিন আগেও দেশের ছয় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল। আর শীত মৌসুম শুরুর পর থেকে কমপক্ষে দেশের তিন/চার জেলার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিংবা তার কম/বেশি থাকতে দেখা গেছে। এর ফাঁকে ফাঁকে ছিল বৃষ্টিপাত।
আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাবে, গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্রা ঢাকাতেই ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতেও হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে। এমনকি উত্তরাঞ্চলে বন্যাও হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ মো.আব্দুল হামিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবারের শীত মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ছিল। জানুয়ারিতে ঢাকায় ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল। সেই পরিমাণ বৃষ্টিও হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও আবার স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশিও হয়েছে। আবার অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় এবার দেশে শীত বেশি সময় অবস্থান করেছে। এখনও দেশের উত্তরাঞ্চলে দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।’
তিনি জানান, এবার বৃষ্টি যেমন স্বাভাবিকের চেয়ে কখনো বেশি কখনো কম; শীতের ক্ষেত্রেও কখনো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, আবার কখনো কম অনুভূত হয়েছে।
এদিকে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বর্তমানে দেশের পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশে আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক সারাবাংলাকে জানান, এ সময় রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও দিনের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রংপুর বিভাগের তেঁতুলিয়ায় ৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া রাজারহাটে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি ও চুয়াডাঙায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহী ও ঈশ্বরদীতে যথাক্রমে ১০ দশমিক ০২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও দু’দিন সময় লাগবে।
ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গেল ডিসেম্বর থেকে অর্থাৎ শীত মৌসুমের শুরু থেকে বঙ্গোপসাগর উত্তপ্ত ছিল। ডিসেম্বরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা মূল ভূ-খণ্ডের চেয়ে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এ কারণে অন্যান্য বছরগুলোর চেয়ে এবার হিমালয় থেকে শীতল বাতাস বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে সারাদেশে ছড়িয়ে ডিসেম্বরের শেষে শৈত্যপ্রবাহের সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর সুত্রও বলছে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে যে তাপমাত্রা ছিল তা গত ৩০ বছরের একই সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার গড়ের চেয়ে বেশ কম। ওই সময়ে দেশের তাপমাত্রা ছিল রাতে গড়ে ৯ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দিনের তাপমাত্রা ছিল ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই তাপমাত্রা গত ৩০ বছরের ওই সময়ের তাপমাত্রার গড়ের চেয়ে ১ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম। যে কারণে এবার শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হয়েছে।
এদিকে ভারত মহাসাগরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একদিকে সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম, আবার অন্যদিকে পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা ছিল। এই পরিস্থিতিকেই বিশ্লেষকরা দ্বি-মেরু পরিস্থিতি হিসেবে অভিহিত করেছেন। যার প্রভাবে বাংলাদেশে এবার শীত মৌসুমে তারতম্য দেখা গেছে।
আবার শীত মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে বেশ কয়েকটি মাঝারি ও ছোট ধরনের লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর কাছাকাছি এলাকায় বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। সে কারণে শীতের বিদায়ের জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম