Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হুমকিতে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য, কাগজে বন্দি পরিকল্পনা

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:৫৫

কক্সবাজার: সেন্টমার্টিন। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। অন্যতম দর্শনীয় স্থানও। কিন্তু দখল-দূষণে সেই প্রবাল দ্বীপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। গত ২৩ বছর আগে দ্বীপটিকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাস্তবায়ন হয়নি কোনো পরিকল্পনা। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে বলে ধারণা পরিবেশবিদদের।

প্রবাল পাথরবেষ্টিত স্বচ্ছ নীল জলরাশির ৮ দশমিক ৩০ বর্গ কিলোমিটারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আর্কষণীয় স্থান। এই দ্বীপের প্রকৃত বাসিন্দা ৯ হাজার। তবে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন এই দ্বীপে যাতায়াত থাকে ২০ হাজারের বেশি মানুষের।

১৯৯৯ সালে এই দ্বীপকে ‘ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল’ এরিয়া বা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে এই দ্বীপকে দখলমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখতে নানা পদক্ষেপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ। এই ২৩ বছরে তেমন কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ও অবৈধ দখলের কারণে এই দ্বীপ আজ ঝুঁকিতে।

সরেজমিনে সেন্টমার্টিন গিয়ে দেখা যায়, বালিয়াড়িসহ দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিক দ্রব্য, চিপসের প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ, পানির বোতল, ডাবের খোসা, স্ট্র, খাবারের প্যাকেট, মাছ ধরার ছেঁড়া জাল, নাইলন দড়ির টুকরোসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য। এছাড়াও সেন্টমার্টিনের শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁর সঙ্গে যোগ হয়েছে গৃহস্থালির ফেলা বর্জ্য। প্রায় বেশিরভাগ হোটেলে নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এসব বর্জ্যের পাশাপাশি সমুদ্রের পানিতে পড়ছে পর্যটকদের ব্যবহৃত নানা প্লাস্টিক।

এছাড়া যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইট-কনক্রিটের রিসোর্ট ও বহুতল ভবন। বাণিজ্য নগরীতে পরিণত হওয়া এই দ্বীপে কনক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের ওপর বিধিনিষেধ থাকলেও তার তোয়াক্কা করছে না কেউই।

ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষা এখন সময়ের দাবি— এমনটিই বলছেন সচেতন মহলসহ পরিবেশবিদরা। সেন্টমার্টিনে বেড়াতে আসা সাংবাদিক সুনীল বড়ুয়া বলেন, দ্বীপের সৌন্দর্য রক্ষায় ময়লা-আবর্জনা প্রতিরোধ করে জীববৈচিত্র্য রক্ষা এখন সময়ের দাবি। সেটি না করতে পারলে এই দ্বীপ রক্ষা করা যাবে না।

সেন্টমার্টিনে বেড়াতে আসা পর্যটক রাফিদুল হাসান বাপ্পি বলেন, স্বচ্ছ জ্বলের দ্বীপ দেখতে এসে পানিতে যখন নোংরা প্লাস্টিক আর আবর্জনা দেখা যায়, তখন খুব খারাপ লাগে। এছাড়া দখলবাজদের থাবা এখানেও দেখা যাচ্ছে। এটি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই নয়। প্রশাসন চাইলে এই দ্বীপকে পর্যটকবান্ধব করতে পারে।

পরিবেশ অধিদফতরসহ দ্বীপ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অ্যাডভোকেট আয়াসুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সেন্টমার্টিন যেভাবে সাজানোর কথা ছিল, সেভাবে সাজানে হয়নি। দখল আর দূষণে এই দ্বীপ হারিয়েছে নিজস্ব রূপ। সৃষ্টি হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। শুধু কথায় নয়, এই দ্বীপ রক্ষায় আন্তরিক প্রচেষ্টা দরকার।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারসহ দ্বীপ রক্ষায় একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দ্বীপের চারদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ফলে দ্বীপের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। মানবসৃষ্ট পরিবেশ ধ্বংসের কারণে দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তবে এখানকার দখলদারদের কাছে নিজেরা অসহায় বলে জানালেন সেন্টমার্টিনের পরিবেশ অধিদফতরের কর্মী আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ভ্রমণ করতে আসা পর্যটক ও প্রভাবশালী দখলবাজরা কোনো কথায় পাত্তা দেয় না। পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষে একা এই দ্বীপ রক্ষা করা সম্ভব না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, সেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘অসচেতনতার কারণেই সেন্টমার্টিন দূষিত হচ্ছে। তবে আবর্জনা অপসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ দখলদারদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব দখল হয়েছে আরেও প্রায় ১৫-২০ বছর আগে।’ চেয়ারম্যান এ কথা বললেও স্থানীয়রা অবশ্য বলছেন, এখনো দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত হয়েছে এই প্রবাল দ্বীপে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিভিন্ন দূষণের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের চাপে দ্বীপে অতিরিক্ত বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে। এর মধ্যে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্যাকেট ও বোতল সৈকতজুড়ে প্রতিনিয়ত দূষণের কারণ হচ্ছে। এজন্য অন্তত পর্যটন এলাকাগুলোতে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক, পলিথিন ও চিপসের প্যাকেট ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষায় গত ৪ জানুয়ারি সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চল বা মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়া সেন্টমার্টিনের ইকোট্যুরিজম উন্নয়নে পরিকল্পনাসহ ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রী কার্যলয়। তাই প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারির পাশাপাশি দ্বীপকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান সকলের।

সার্বিক বিষয়ে কথা হলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিনে জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এরপরেও কিছু অসাধু ব্যক্তি অবৈধ উপায়ে ইট-কাঠ নিয়ে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করছেন। যা প্রতিনিয়ত উচ্ছেদও করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা সব ব্যবস্থায় নেওয়া হচ্ছে। সেখানকার পরিবেশের জন্য কেয়াবন খুবই জরুরি। এজন্য কেয়াবন বিস্তৃত করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।

সারাবাংলা/টিআর


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০০

সম্পর্কিত খবর