Saturday 12 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গর্বিত দাসত্বের উত্থান শিক্ষাব্যবস্থায় দাসত্বের নিগড়

আসাদুজ্জামান বুলবুল
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৩

মানুষের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হচ্ছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব। ইতিহাস জুড়ে দেখা গেছে, মানুষ তার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে, এমনকি জীবনকেও বিপন্ন করেছে। তবে আজকের পৃথিবীতে এই স্বাধীনতাকেও এক ধরনের দাসত্বের রূপে রূপান্তর করা হয়েছে, যার চেহারা আগের দাসত্বের মতো প্রকাশ্য নয়। এটা এমন এক নতুন দাসত্ব, যেখানে শিকল নেই, শারীরিক অত্যাচার নেই, কিন্তু মনের গভীরে স্থাপিত শৃঙ্খল মানুষকে আত্মতৃপ্তির হাসিতে বন্দি করে রাখছে। এই দাসত্বে মানুষ নিজেই আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে এবং স্বেচ্ছায় নিজেকে শৃঙ্খলিত করছে।

বিজ্ঞাপন

আমরা প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখি, কেউ বড় কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার খবর দিচ্ছে, গর্বের সঙ্গে পোস্ট করছে— “স্টার্ট জব অ্যাট ইউনিলিভার” বা “স্টার্ট জব অ্যাট পাবলিক সার্ভিস।” এই উচ্ছ্বাস, এই গর্ব যেন নতুন রূপের দাসত্ব। এটা এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে মানুষ দাসত্ব বরণ করছে আনন্দের সঙ্গে, এবং শেকল পরা অবস্থায় নিজেকে সফল মনে করছে। মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, কর্পোরেট কিংবা সরকারি চাকরির মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য। প্রশ্ন হচ্ছে দাসত্বের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটল? কীভাবে এই নতুন দাসত্ব আমাদের সমাজে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো যে মানুষ নিজেই তা মেনে নিচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের দিকে নজর দিতে হবে। ওরিয়েন্টালিস্টরা প্রথমে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে আঘাত করে। তারা আমাদের মানসিকতাকে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে ফেলে গড়ে তোলে, যেখানে আমরা নিজেদের শেকড় ভুলে গিয়ে বিদেশি সংস্কৃতি এবং চিন্তাধারাকে গ্রহণ করতে শুরু করি। এর মাধ্যমে জাতির মস্তিষ্ককে দুর্বল করা হয়, যাতে স্বাধীন চিন্তার জায়গা থেকে মানুষ সরে আসে।

বিজ্ঞাপন

যখন একটি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, দর্শন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হারিয়ে যায়, তখন সেই জাতি চিন্তার ক্ষেত্রে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে সাম্রাজ্যবাদীরা সহজেই তাদের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে পারে। ফলে জাতি নিজের স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারে না এবং দাসত্বকে শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে দেখে। আমাদের সমাজেও এই প্রক্রিয়া সুক্ষ্মভাবে ঘটেছে, যেখানে আমরা কর্পোরেট দাসত্বকে গর্বের সঙ্গে বরণ করছি।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দাসত্বের নিগড় পরিলক্ষিত, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এই দাসত্বের প্রভাব গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা প্রশাসনকে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী যদি দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য বা ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়, তাহলে তাকে সমাজের তিরস্কার এবং অবজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়। একজন শিক্ষার্থী যখন কলা ও মানববিদ্যায় ভর্তি হয়, তখন সমাজের একাংশ থেকে তাকে বলা হয়, “তোমার ভবিষ্যৎ কোথায়? তুমি চাকরি পাবে কীভাবে?” কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে শুধু যান্ত্রিক দক্ষতা অর্জন হয়, যা মানুষকে কর্পোরেট দাস বানায়।

অন্যদিকে, দর্শন, ইতিহাস, ভাষা এবং সাহিত্য চর্চা মানুষকে চিন্তাশীল করে তোলে, তাকে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং স্বাধীন চিন্তার জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা দর্শন এবং তাত্ত্বিক চিন্তাকে ভয় পায়, কারণ এখান থেকেই বিপ্লবী চিন্তা জন্ম নেয়। তাই পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদীরা মানববিদ্যা চর্চাকে নিরুৎসাহিত করে, যাতে মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে না, ভাবতে শেখে না।

পোস্ট-কলোনিয়াল মানসিকতা: রুটি-রুজির চিন্তায় আবদ্ধ শিক্ষা

পোস্ট-কলোনিয়াল মানসিকতা আমাদের সমাজে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে আমরা এখন তাৎক্ষণিক রুটি-রুজির জন্য পড়াশোনা করি। যে পড়াশোনা আমাদের তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো অর্থনৈতিক লাভ দিতে পারে, সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই মানসিকতা তৈরির পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত, কারণ যান্ত্রিক পড়াশোনায় তাদের কোনো ভয় নেই। এতে সমাজে আধুনিক দাস তৈরি হয়, যারা সৃজনশীলতা এবং বিপ্লবী চিন্তার জায়গা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে।

একটি সমাজ যখন মানববিদ্যা, দর্শন, ইতিহাস এবং ভাষা থেকে দূরে সরে যায়, তখন সে সমাজ ধীরে ধীরে চিন্তার দাসত্বে পতিত হয়। পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদীরা জানে যে দর্শন, ইতিহাস এবং সাহিত্য মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে, বিপ্লবী ভাবনার জন্ম দিতে পারে। তাই তারা সুচারুভাবে এই বিষয়গুলোর চর্চাকে নিরুৎসাহিত করে।

আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায় হলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মানববিদ্যার গুরুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের যান্ত্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু তাত্ত্বিক জ্ঞান ছাড়া কোনো জাতি তার চিন্তার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে পারে না। ইতিহাস এবং দর্শন মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং প্রশ্ন করার ক্ষমতা দেয়।
আমাদের সমাজে এক ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঘটেছে, যা আমাদের চিন্তাশক্তিকে শৃঙ্খলিত করেছে। কর্পোরেট চাকরি এবং যান্ত্রিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে একটি দাসত্বের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছি। অথচ, স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং মানববিদ্যার চর্চা ছাড়া প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়।

বর্তমানে আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে: কর্পোরেট দাসত্বের শৃঙ্খলিত জীবন বেছে নেওয়া, নাকি নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভিত্তিতে সত্যিকারের স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া। একদিকে রয়েছে শেকলমুক্ত কিন্তু চিন্তার দাসত্ব, আর অন্যদিকে রয়েছে সৃজনশীল এবং মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা।

আমাদের সমাজে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন এক সাংস্কৃতিক এবং মানসিক দাসত্ব তৈরি করেছে, যা মানুষকে তাদের নিজেদের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। মানুষ নিজের চিন্তার জায়গা থেকে সরে এসে কর্পোরেট জীবনের চাকচিক্যকে বরণ করছে। অথচ, যদি আমরা আমাদের শেকড়ের দিকে ফিরে তাকাই, যদি আমরা আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং দর্শনের চর্চা করি, তাহলে আমরা প্রকৃত মুক্তি অর্জন করতে পারব।

মানুষ কি কর্পোরেট দাসত্বে বন্দি থাকবে, নাকি সে নিজের স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধার করবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষের চিন্তার ওপর, যারা এখনও শৃঙ্খলমুক্ত চিন্তা করতে সক্ষম।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এজেডএস

আসাদুজ্জামান বুলবুল গর্বিত দাসত্বের উত্থান শিক্ষাব্যবস্থায় দাসত্বের নিগড়

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর