ফেব্রুয়ারির ১৯ দিনের মৃত্যু শেষ ৩ মাসের চেয়ে বেশি
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:২১
ঢাকা: দেশে কমছে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা। একইসঙ্গে কমছে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। তবে দেশে ফেব্রুয়ারি প্রথম ১৯ দিনে ৫৫০ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে বলে জানানো হয়েছে সরকারিভাবে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই ১৯ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই তিন মাসে ৫২৬ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয় মারা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও কোভিড ইউনিটের প্রধান ডা. মো. জাকির হোসেন খানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ১৫০ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এই ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৩ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে বলেও জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩১ লাখ ৮৩ হাজার ৬২টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৯ লাখ ৩১ হাজার ৩০৪ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানানো হয়। দেশে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে ২৮ হাজার ৯৪৪ জন।
ফেব্রুয়ারির ১৯ দিনের মৃত্যুসংখ্যা ও বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ
দেশে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে ৫৫০ জন। এর মাঝে চারজনে বয়স ১০ বছরের নিচে। সর্বোচ্চ ৩৬৯ জন মারা গেছে যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি। ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৮৩ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সসীমায় ৫৩ জন ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ২১ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে। এছাড়াও ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১৫ জন ও ১১ থেকে ২০ বছর বয়সসীমায় পাঁচ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারির মৃত্যু সংখ্যা
দেশে ২০২১ সালের নভেম্বরে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যায় ১১৩ জন। ডিসেম্বরে মৃত্যু হয় ৯১ জনের। আর সর্বশেষ জানুয়ারিতে মারা গেছে ৩২২ জন। অর্থাৎ নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে ৫২৬ জন।
সতর্ক থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেভাবে সংক্রমণ শনাক্তের হার কমছে সেটা চলতে থাকলে হয়তোবা এই মাসেই পাঁচ শতাংশের নিচে চলে আসতে পারে। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়বেই। আর তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। সংক্রমণের উৎস ও উৎপত্তিস্থল বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায় যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছিল তা আশঙ্কাজনক। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি ছিল। সংক্রমণ শনাক্তের হার এখন কমে আসছে। মৃত্যুর সংখ্যাও যদি কমে আসে তবে নিম্নমুখী ধারা বলা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে ভ্যারিয়েন্ট যাই আসুক না কেন, ভাইরাস থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে হলে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। একইসঙ্গে হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে। মাস্ক না পরে যদি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করে, তবে লাভ কী! কেউ যদি ভাইরাসকে নিজের কাছে প্রবেশের সুযোগ না দেয়, তাহলে ভাইরাসের পক্ষে কাউকে আক্রান্ত করা সম্ভব না। সে কারণেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন নিতে হবে। ভ্যাকসিন একদিকে যেমন সংক্রমণের ঝুঁকি কমাবে, অন্যদিকে সংক্রমিতদের হাসপাতালে যাওয়ার সংখ্যাও কমাবে।’
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতেই হবে
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই মূলত সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে সংক্রমণ বাড়িয়েছে, একই ধরনের প্রবণতা বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘোষণাই বলছে, দেশে এই ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এরই মধ্যে ঘটে গেছে। এ বছর করোনাভাইরাসের যেসব নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তার সিংহভাগেও মিলেছে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি।
ওমিক্রনের প্রভাবে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কত দিন থাকবে, সে বিষয়ে অবশ্য এখনই কিছু বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রভাব যাই থাকুক, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। বলছেন, সংকটের এই সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একেবারেই বাইরে চলে যাবে, যার জন্য ভুগতে হবে দীর্ঘ সময়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে নেমে যাচ্ছে নাকি আমরা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চূড়া দেখিনি কিংবা কবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে— এসব বিষয়ে বলার মতো যথেষ্ট তথ্য এখনো কারও কাছেই নেই। সবাই গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে এরপর হয়তো সপ্তাহখানেক একই অবস্থা থাকবে।’
ওমিক্রনের প্রভাবে সারাবিশ্বেই করোনা সংক্রমণের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে উল্লেখ করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংক্রমণের সংখ্যায় মনোযোগ না দিয়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করাটা জরুরি। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে হবে। পরীক্ষা করার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা আক্রান্তদের ফলোআপের আওতায় আনতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে। এসব না করতে পারলে সংক্রমণ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে, বলা মুশকিল।’
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম