অবৈধ ব্যাটারি কারখানায় ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, নষ্ট ফসলি জমি
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:০০
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: প্রায় অর্ধেক দামে কিনে নেওয়া হয় অটোরিকশা ও চার্জার ভ্যানের পুরাতন ব্যাটারি। এরপর পুরাতন ব্যাটারিতে থাকা বিভিন্ন পার্টস খুলে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। পুরাতন ব্যাটারি থেকে বিষাক্ত অ্যাসিডের সিসা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। এসব ব্যাটারির বিষাক্ত অ্যাসিড, সিসা, প্লাস্টিক থেকে বের হওয়া বিভিন্ন বর্জ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানার পাশের ফসলি জমি। ধ্বংস হচ্ছে আশপাশের পরিবেশও।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের বাবু ডাইং-কেন্দুল রাস্তার ধারে ফসলি জমিতেই গড়ে উঠেছে পুরাতন ব্যাটারির কারখানা। ব্যাটারির বিষাক্ত অ্যাসিড ও ধোঁয়ায় পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে আশেপাশের সরিষা, মসুরসহ বিভিন্ন ফসল। কোনো অনুমোদন ছাড়াই ফসলি জমির মাঠে এমন স্পর্শকাতর পদার্থের কারখানা গড়ে তোলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকরা বলছেন, জনবসতিহীন এলাকা হওয়ায় নির্জনতার সুযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক ব্যাটারি ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় এই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়ের মেসার্স আশরা অটো ও কাজল ব্যাটারি সার্ভিসিং সেন্টারের মালিক ব্যাটারি ব্যবসায়ী খুরশেদ আলম কাজল এই কারখানার মালিক। এছাড়াও গাইবান্ধার জাহাঙ্গীর ও মহসীন নামে আরও দু‘জন মালিক রয়েছে কারখানাটির।
এক বছরের জন্য ১৮ কাঠা জমি ইজারা নিয়ে চারদিকে ত্রিপল দিয়ে ঘিরে ফসলি জমিতেই গড়ে উঠেছে কারখানা। স্থানীয়রা জানান, রাত গভীর হলে পোড়ানো হয় পুরানো ব্যাটারির বিভিন্ন পদার্থ। আগুনে পুড়িয়ে পুরাতন ব্যাটারি থেকে ভেতরের সিসা বের করা হয়। পরে এসব পোড়া ব্যাটারির নির্গত সিসা ও অন্যান্য পদার্থ পুনরায় ব্যাটারি তৈরির কারখানায় বিক্রি করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাতে যখন ব্যাটারি জ্বালানো হয়, তখন আশপাশের ৩ কিলোমিটার জুড়ে বিষাক্ত ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এমনকি ইতোমধ্যে আশেপাশের ফসলি জমিতে অ্যাসিড ছড়িয়ে পড়ছে। জমির মালিক চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নামোশংকরবাটি গুমপাড়ার মিজান। গত ৩ মাস আগে মিজানের এই জমিতে পুরাতন ব্যাটারির কারখানা করা হয়। এতে ফসলি জমির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির আশঙ্কা করছেন মৃত্তিকা বিজ্ঞানিরা।
কারখানার পাশেই ১২ বিঘা ফসলি জমি রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নিমগাছি সরকারপাড়া এলাকার মৃত আবু তালেবের ছেলে আতাউর রহমানের। তিনি বলেন, “এটা স্থাপনের ফলে আমার সরিষা ক্ষেত পুড়ে গেছে। এমনকি আশেপাশের সব জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ফসল নষ্ট হচ্ছে। কারখানা মালিকেরা বলছে, ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ করা আছে। তোমাদের যা ইচ্ছে করার করো’।”
সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের কেন্দুল গ্রামের কৃষক বইউদ্দিন জানান, রাতের বেলা পুরানো ব্যাটারিতে আগুন দেওয়া হয়। সেসময় বিশাল কুণ্ডলী তৈরি হয়। বাজে গন্ধযুক্ত ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠে বাতাস। শুনেছি তারা এক বছরের জন্য চুক্তি করে এই ফসলি জমি নিয়েছে। এসব কাজ করতে থাকলে এই এলাকার সব ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। দ্রুত এই কারখানা উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে কৃষি জমিতে কোনো ধরনের কল-কারখানা করা যাবে না। অথচ এখানে ব্যাটারির অ্যাসিড বের করা, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খোলা ও ব্যাটারি পোড়ানোর মতো কাজ করা হচ্ছে। নিজের ব্যবসায়ের স্বার্থে কৃষি জমি ও পরিবেশের ক্ষতি হলেও স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
জানা যায়, পুরাতন ব্যাটারির এই কারখানায় কাজ করা বেশিরভাগ লোক নওগাঁ, বগুড়া, গাইবান্ধার। তারা ব্যাটারির সব যন্ত্রাংশ খুলে আলাদা করে ও ব্যাটারি পুড়িয়ে তা বগুড়ায় পাঠায়। সেখানে নতুন ব্যাটারিতে পুনরায় এসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়। শ্রমিকরা বলছেন, এখানে দৈনিক ১০০-১৫০টি ব্যাটারির যন্ত্রাংশ খোলা ও আগুনে পোড়ানো হয়।
গত বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, অ্যাসিডের কাজে কর্মরত শ্রমিকদের সর্তকতা নেই বললেই চলে। মুখে মাস্ক ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা।
শ্রমিক আনোয়ার আলী জানান, পুরাতন ব্যাটারিগুলো খুলে যন্ত্রাংশগুলো আলাদা আলাদা করা হয়। রাতে ব্যাটারি পুড়িয়ে তা থেকে বিশেষ পদার্থ তৈরি করা হয়। পাশেই গর্ত করে অ্যাসিডগুলো রাখা হয়। তবে গড়িয়ে গড়িয়ে তা আশপাশের জমিতেও যায়। কিন্তু এতে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।
জেলা শহরের বিশ্বরোড মোড়ে পুরাতন ব্যাটারি কেনেন সুমন আলী। তিনি বলেন, ‘জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আমরা ব্যাটারি কিনে থাকি। পরে সেগুলো ঢাকা, নওগাঁ, বগুড়াতে পাঠানো হয়। তবে সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জেও একটি কারখানা হয়েছে। সেখানেই পুরাতন ব্যাটারি খুলে প্রক্রিয়া করা হয়। এসময় আগুনের কুণ্ডলীতে থাকা ধোঁয়ায় আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমাকে বিভিন্ন জেলার কয়েকজন ব্যবসায়ী এই কারখানা করার প্রস্তাব দিলেও পরিবেশের কথা ভেবে তাতে রাজি হইনি।’
‘মেসার্স আশরা অটো ও কাজল ব্যাটারি সার্ভিসিং সেন্টারে’র মালিক ব্যাটারি ব্যবসায়ী খুরশেদ আলম কাজল এ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি জানান, সারাদেশের সব জায়গায় এভাবেই পুরাতন ব্যাটারি প্রক্রিয়া করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমিই প্রথম এটা নিয়ে এসেছি। যখন কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল, তখন মাঠে ফসল ছিল না। তবে এখন কারও ক্ষয়ক্ষতি হলে, তার ক্ষতিপূরণ দিব।’ তবে কারখানা স্থাপনের বিষয়ে কোনো অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই বলেও জানান তিনি।
নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের রসায়ণ বিভাগের প্রভাষক ফাউজিয়া তাবাসসুম জানান, অটোরিকশার ব্যাটারিতে সালফিউরিক অ্যাসিডসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফসলি জমির পাশাপাশি মানবদেহে এসব অ্যাসিড মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এসব অ্যাসিডের প্রভাবে ক্যানসার, কিডনির বিভিন্ন সমস্যা, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহী মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফার বলেন, ‘ফসলি জমিতে যেকোনো ধরনের অ্যাসিডের কারণে মাটির পিএইচ বেড়ে যায়। এতে মাটি অতিরিক্ত ক্ষার হয়ে যায়। ফলে গাছপালা মাটি থেকে তার খাদ্য গ্রহণ করতে পারে ন। গাছের ফলন হয় না এবং গাছ বাড়েও না।’
জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিব খান জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তাছাড়া কৃষি জমির ক্ষতি করে এভাবে ব্যাটারির অ্যাসিডের কারখানা করতে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/এমও
অবৈধ ব্যাটারি কারখানা ধ্বংস পরিবেশ পুরাতন ব্যাটারি ফসলি জমি বিষাক্ত অ্যাসিড