মেলার দর্শকশূন্য কোণে বাংলা কাব্যে বঙ্গবন্ধু
১ মার্চ ২০২২ ২৩:১৯
সাড়ে সাত লাখ বর্গফুটের বইমেলায় মুগ্ধতা ছড়ানোর নানা দিক রয়েছে। এই যেমন ধরুন— টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে বাংলা একাডেমি গেট অথবা দোয়েল চত্বর থেকে বাংলা একাডেমি গেট পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে মেলায় ঢোকার যে বিড়ম্বনা, সেটি এখন আর নেই। টিএসসি গেট, বাংলা একাডেমি গেট ও রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট গেট দিয়ে অনায়াসে মেলায় ঢোকার চমৎকার ব্যবস্থা রেখেছে মেলা কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ লাইন, হুড়োহুড়ি, পাড়াপাড়ির দিন শেষ হয়েছে গত বছর থেকেই।
একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা বৃত্তের মধ্যে এত পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রয়েছে যে মেলার মধ্যে আরেকটি মেলা অনায়াসে মিলিয়ে ফেলা যায়। লেখক, পাঠক, প্রকাশক, দর্শনার্থী তো বটেই, মেলার সার্বিক নিরাপত্তা নিয়োজিত র্যাব-পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ও কর্তব্যক্তিদের জন্য মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে আয়োজকদের চেষ্টার কমতি নেই।
বরাবরের মতো গ্রন্থ উন্মোচন, লেখক বলছি মঞ্চ, নতুন বইয়ের স্টল, শিশু চত্বর, পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য প্রশস্ত পথ, আশ্রয় কেন্দ্র, পার্কিং ব্যবস্থা, ব্রেস্ট ফিডিং জোন, নামাজ ঘর, টয়লেট ব্যবস্থা, হুইল চেয়ার, ফুডকোর্ট তো রয়েছেই।
এবার ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর, সংবিধান রচনার ৫০ বছর। সুতরাং ভাষা আন্দোলন, বঙ্গব্ন্ধুর জন্মশতবর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও সংবিধানপ্রাপ্তির এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাঙালির ‘চেতনা জাগানিয়া’ বইমেলা আয়োজনে একটা ভিন্নমাত্রা যোগ হবে— এটাই স্বাভাবিক। এসব দিক মাথায় রেখেই হয়তো এবারের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।
প্রতিপাদ্যের মর্মার্থ ঠিক রাখতে কিছু উদ্যোগও নিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। যেমন— বঙ্গবন্ধুর জন্য শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্বাধীনতার মর্মবাণী সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থভুক্ত হস্তলিপি বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে স্থাপনাগুলো যেমন সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে, তেমনি লিপি পাঠ করে তরুণ সমাজ বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। একইসঙ্গে তার চিন্তা ও দর্শনের অন্তর্নিহিত অর্থও উদ্ধার করার প্রয়াস পাচ্ছে তারা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ বাস্তবায়ন কমিটি একটি প্যাভিলিয়ন নিয়েছে। এই প্যাভিলিয়নটি হয়ে উঠেছে দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
এতসব ‘ভালো’র মধ্যে কিছু ‘ভুল’, কিছু ‘ত্রুটি’ কিছু ‘খেয়ালিপনা’ চোখের আরাম, মনের শান্তি ও চিন্তার সারল্য নষ্ট করেছে। উদ্রেক করেছে নিদারুণ যন্ত্রণার।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত যত কবিতা লেখা হয়েছে তার ভেতর থেকে বেছে বেছে প্রখ্যাত কবিদের বিখ্যাত কবিতার অংশ দিয়ে যেসব ডিসপ্লেবোর্ড তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একাডেমি প্রাঙ্গণের পুকুরপাড়ে। পুকুরের পশ্চিম-উত্তর কোণের যে জায়গাটিতে দর্শনার্থীদের খুব একটা আনাগোনা নেই, সেখানে সাঁটানো ২৪টি বোর্ডসহ পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ৪৫টি ডিসপ্লে বোর্ডে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত নানা পঙ্ক্তি—
তোমার আসার অপেক্ষায় ছিল সব…
বাংলার নদনদী থেকে, হাওড়, বিল, দিঘির কাকচক্ষু জল
তোমার অপেক্ষায় ছিল মাছরাঙা, ধবল বক, পানকৌড়ি,
শালিক,চিল, মেটে-রঙ দোয়েলের বুক…
– সিকদার আমিনুল হক (তোমার অপেক্ষায় ছিল সবাই)
মাঠময় শস্য তিনি ভালোবাসতেন,
আয়ত দু’চোখ ছিল পাখির পিয়াসী
পাখি তার খুব প্রিয় ছিল-
গাছ-গাছালির দিকে প্রিয় তামাকের গন্ধ ভুলে
চোখ তুলে একটুখানি তাকিয়ে নিতেন,
পাখিদের শব্দে তার, খুব ভোরে, ঘুম ভেঙে যেত।
স্বপ্ন তার বুক ভ’রে ছিল,
পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহে-আর্দ্র চোখ-
এ দেশের যা কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র
তার চোখে মূল্যবান ছিল-
নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল:
স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে প’ড়ে আছে
বিশাল শরীর
– রফিক আজাদ (এই সিঁড়ি)
বঙ্গবন্ধু। তোমার বন্ধু আজ বাংলার জনগণ
টুঙ্গিপাড়ার কবরে শুয়ে কি শোনো না তাদের ক্রন্দন?
আর একবার তুমি ডাক দাও।
এই দেশ হতে কুকুর তাড়াও
তুমি ডাক দিলে আবার দাঁড়াবে শিরখাড়া করে জনতা।
জয়বাংলার বজ্রধ্বনিতে প্রাণ পাবে মরা স্বাধীনতা।’
– আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী (বঙ্গবন্ধু)
মৌল আঁধার এসে দীর্ঘকাল
ঢেকে রেখে ছিল এই চোখ- তাকাতে পারিনি
দূরে, সূর্যোদয়ও ঢাকা পড়েছিল বহুদিন
প্রত্যুষের আদি আলো থমকে গিয়েছে দরজায়
সিঁড়িতে আবদ্ধ এই মানুষের চোখ দীর্ঘদিন জাগেনি প্রত্যুষে।
অন্যদিকে কানের পর্দা-ফুটো করে সারাবেলা
মস্তিষ্ক গহ্বরে দিয়ে উগ্র করতালি
তস্করের দল অকস্মাৎ বেদখল করে নেয় জাতির গৌরব।
– বিমল গুহ (শেখ মুজিবের তর্জনী)
কেবল এই পঙ্ক্তিগুলোই নয়, সেখানে আরও রয়েছে কবি নুরুল হুদার ‘অনন্ত মুজিব জন্ম’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু’, হায়াৎ মামুদের ‘মুজিবের এফিটাফ’, নির্মলেন্দু গুণের ‘সেই রাতের কল্পকাহিনী’, মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’, শহীদ কাদরীর ‘হন্তারকদের প্রতি’, বেলাল চৌধুরীর ‘বত্রিশ নম্বর’ সৈয়দ শামসুল হকের ‘প্রয়াত পিতার উদ্দেশে খেদ ও শোকসূচক একটি রচনা’, শামসুর রহামানের ‘ইলেক্ট্রার গান’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘রাত্রির তৃতীয় যামে’, মাহবুব আলম চৌধুরীর ‘গরাদ ভাঙার সংগ্রামীরা জাগো’, মযহারুল ইসলামের ‘একটি সূর্যের হাত ধরে’, সুফিয়া কামালের ‘মুজিবের জন্মদিন’, জসীম উদ্ দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর, ‘আমি অপেক্ষা করছি’ হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একান্ত মানচিত্র বাংলার’ আসাদ চৌধুরীর ‘এ কেমন জন্মদিন’, রবিউল হুসাইনের ‘যেহেতু তিনি খুব বড় ধরনের মানুষ ছিলেন’, অসীম সাহার ‘তার নিজস্ব গন্তব্যে’, আসাদ মান্নানের ‘বাঙালির বেহুলাবাসর’, অরুনাভ সরকারের ‘মুছে দেব সমস্ত শৈবাল’, ঝর্ণা রহমানের ‘মানচিত্রের প্রাণপুরুষ’, মাকিদ হায়দারের ‘হৃদপুরে’, কামাল চৌধুরীর ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’, আসলাম সানীর ‘আমি প্রাচীন আর্য-দ্রাবিড় আমি বাঙালি’, সিকানদার আবু জাফরের ‘ফিরে আসছেন শেখ মুজিব’, আবুল হোসেনের ‘জাতির পিতা তিনি’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু নিয়ে লেখা কালজয়ী কবিতার অংশ বিশেষ।
শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট কন্যা শেখ রেহানার লেখা ‘বাবা’ কবিতাটিও বইয়ের অনুকৃতির মধ্যে পুকুরের সিঁড়ির ওপরে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
ডিসপ্লে বোর্ড ছাড়াও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভবনের কোণায় একটি ডিজিটাল জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয়েছে। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা কবিতার আবৃত্তি, তার ভাষণ-বক্তৃতা অথবা তার জীবনালেখ্য প্রদর্শনের জন্যই এই আয়োজন। কিন্তু গত চার দিন বিকেল ৩টা, সাড়ে ৩টা, ৪টা ও সাড়ে ৪টায় বেশ কয়েকবার ঢুঁ মেরেও ত্রিপলে আবৃত দেখা গেছে এই ডিজিটাল মনিটর। একেবারে পেছন দিক হওয়ায় ওদিকে কেউ যাচ্ছেন না। কৌতূহলী দর্শনার্থীদের কেউ কেউ ওদিকটায় ঢুঁ মারলেও দাঁড়াচ্ছেন না।
অর্থাৎ জোরাল আয়োজনের ‘আপাত সফল’ মেলার সবচেয়ে আবেগী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেই যেন ‘ভুল’ জায়গায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সাড়ে ৭ লাখ বর্গফুটের মেলায় হাজার হাজার বর্গফুট ফাঁকা পড়ে থাকলেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতাগুলোর ডিসপ্লে বোর্ড রাখা হয়েছে মেলার দর্শকশূন্য কোণে অনেকটা অবহেলা-অনাদরে।
বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা এভাবে দর্শকশূন্য কোণে কেন রাখা হয়েছে— জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগ) এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপনার মূল্যায়ন হয়তো ঠিক। পরবর্তী আয়োজনে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেবে বাংলা একাডেমি। তবে কেন এভাবে দর্শকশূন্য কোণে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালার ডিসপ্লে বোর্ড রাখা হলো, সেই ব্যাখ্যা দিতে পারবেন স্টেজ ব্যবস্থাপনায় যিনি ছিলেন তিনি।’
মঞ্চ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ফারহান ইশরাক রয়েছেন জানিয়ে তার কাছ থেকে এ বিষয়ে জানার পরামর্শ দেন ড. জালাল। তবে ফারহান ইশরাককে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
অমর একুশে গ্রন্থমেলা বইমেলা বইমেলা ২০২২ বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা বাংলা একাডেমি