Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বাবা বললেন— লিডার লিডস দ্য ল্যাড, ল্যাড শুড নট লিড দ্য লিডার’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৭ মার্চ ২০২২ ২০:৪০

ঢাকা: একাত্তরের ৭ মার্চে দেওয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে ওই সময়কার ছাত্রলীগসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের নানা সমালোচনা ছিল। তাদের অনেকেই বলে থাকেন, সেদিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুর। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলছেন, সেদিন মানুষের মনে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটি ঠিকই পূরণ হয়েছিল।

সেদিনের সেই ভাষণের আগেও অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তবে বঙ্গবন্ধু তার অবস্থানে অটল ছিলেন। তখনকার ছাত্রলীগ নেতাদের তিনি বলেছেন— নেতা হিসেবে তিনিই নির্ধারণ করবেন কী করা উচিত।

সোমবার (৭ মার্চ) দুপুরে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাপতির বক্তব্যে তিনি একাত্তরের সেদিনের স্মৃতিচারণও করেন। বলেন, বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণে গোটা দেশের মানুষ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন- ‘৭ মার্চের ভাষণ যুগ যুগ ধরে বাঙালিকে প্রেরণা দিয়ে যাবে’

সেদিনের স্মৃতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ ঘিরে আগ্রহ ছিল সারাদেশের মানুষের। তখন প্রতিদিনই মিছিল হতো। এমন দিন নেই যে ৩২ নম্বরে (বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের এলাকা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক) মিছিল আসেনি। বঙ্গবন্ধু কখনো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, কখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি মিছিল দেখতেণ। ওই সময় আমাদের রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্ররা আসছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে কী বলতে হবে, তা নিয়ে লিখিত আকারে নানা পয়েন্ট দিচ্ছিলেন। দিস্তা দিস্তা কাগজে সেসব পরামর্শ।

শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চের সেই ভাষণের আগের দিন সন্ধ্যায় সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা এলেন। দোতলার লবিতে বসেছিলেন। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সিরাজুল আলম খান খুব জোর দিয়ে বলছিলেন— লিডার, কাল (৭ মার্চ) কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিতে হবে। বাবা শুনে কিছুই বলেননি। শুধু হাসলেন এবং দুই নেতার (সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক) কাঁধে দুই হাত রেখে বললেন, ‘সিরাজ, লিডার শুড লিড দ্য ল্যাড, ল্যাড শুড নট লিড দ্য লিডার— এ কথাটা মনে রাখিস।’ এ কথা বলে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে এ কথা বলে বিদায় দিয়ে দিলেন।

৭ মার্চ সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও স্বাধীনতার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছু নিয়েই বঙ্গবন্ধু আরও আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালে কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে গিয়েছিলেন। তখনো তার মনে ছিল কীভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যায়। সেখানে বসেই তিনি সব পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামকে কীভাবে সাজাবেন, কীভাবে দেশের উন্নতি হবে, দেশ স্বাধীন করার জন্য গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হলে কী করতে হবে, শরণার্থী হলে তাদের থাকার ব্যবস্থা কী হবে, যুদ্ধ করতে হলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, অস্ত্রের সংস্থান কীভাবে হবে— সবকিছু তিনি লন্ডনে বসে করেছিলেন। কিন্তু কখনো প্রচার বা প্রকাশ করেননি। শত্রুকেও বুঝতে দেননি। সেসব পরিকল্পনার এক জন সাক্ষীই বোধহয় আমি আছি।

৭ মার্চ উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা আরও বলেন, নিয়তান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে ধীরে ধীরে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেছেন। সেই উনসত্তরের ৮ নভেম্বর তিনি লন্ডন থেকে ফিরলেন। এরপর সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু তখনো বলেননি, আমি এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করব বা যুদ্ধ করব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের সব প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন। একাত্তরের মার্চে সংসদ ডেকেও বাতিল করা হলো। তখন সারাদেশের মানুষ উত্তাল সাগরের মতো ফুঁসে উঠল। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আর মিছিল। ওই ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি ৭ মার্চ আবার কথা বলব। এরপরই আমাদের সঙ্গে যারা রাজনীতি করত, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে উঠল— এই মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি ওই দিনের ঘটনা অনেকবার বলেছি, আবারও বলি।

এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা ৭ মার্চের আগের দিনের ঘটনাগুলো তুলে ধরেন। বলেন, কীভাবে বঙ্গবন্ধু সবার মতামত নিয়েও নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন, প্রতিবেদনের শুরুতেই সে ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলেও সেই ভাষণ দেশের মানুষকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিল বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, এখন তো ১৯ মিনিটের মতো রেকর্ড আছে। কিন্তু মূল ভাষণটা ছিল আরও বেশি, প্রায় ২৩-২৪ মিনিটের। ওই ভাষণ দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছিলেন, মিছিলে তখন লাখো মানুষ খুশিতে টগবগ করছিল। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে দিতে মানুষ এগিয়ে আসছিল। মানুষের সেই উচ্ছ্বাসটা এখনো মনে আছে। মনে হচ্ছি, তারা যা চেয়েছিল ঠিক সেই জিনিসটিই যেন পেয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- সব দেশেই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে: প্রধানমন্ত্রী

৭ মার্চের ওই সময়কার ছাত্রনেতাদের প্রতিক্রিয়ার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বাসায় ফিরে দেখি সিরাজুল আলম খানসহ কয়েক নেতা সেখানে উপস্থিত। তারা আগেই চলে এসেছেন। এসেই বলছে— লিডার এটা কী হলো! সব মানুষ তো ফ্রাস্ট্রেটেড (হাতাশ) হয়ে চলে গেছে, হতাশ হয়ে চলে গেছে। মানুষ যা চাচ্ছিল, তা হয় নাই।

শেখ হাসিনা  বলেন, এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনারা মিথ্যা কথা বলেন কেন? আমি স্পষ্ট বললাম, আব্বা, ওনাদের কথা বিশ্বাস করবেন না। কারণ আমি নিজে দেখে এসেছি— মানুষ যা চায় তা পেয়ে গেছে। তারা খুশিতে লাফাতে লাফাতে মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে চলে গেছে। তারা হতাশ হলো কোথায়? আমি ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলাম। আমি তখন একজন ছাত্রলীগকর্মী, তারা নেতা। কিন্তু তাদের মুখের ওপর কথা বলতে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। কারণ সবসময় আমি সত্যের সঙ্গে, সংগ্রামের সঙ্গে ছিলাম।

সেদিন ছাত্রনেতাদের কথায় বঙ্গবন্ধু কর্ণপাত না ধরে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন বলেই স্বাধীনতা এসেছে বলেও মনে করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সেদিন কেন তারা ওই কথা বলেছিল, সেটা নিয়েই সন্দেহ হয়। সেদিন যদি ওই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, পরিস্থিতি কী হতো? কিছু অর্জন করতে হলে ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। বঙ্গবন্ধু সেটিই করেছেন। এজন্যই শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হয়েছে।

আরও পড়ুন- বিএনপির নেতৃত্ব কোথায়?— প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ; সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন; শ্রম ও জনশক্তি সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ; ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে এস এম মান্নান কচি ও হুমায়ুন কবির।

সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন প্রান্তে সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এই প্রান্ত থেকেই সভায় ভাচুয়ালি যুক্ত ছিলেন শেখ হাসিনা।

সারাবাংলা/এনআর/টিআর

৭ মার্চ ৭ মার্চের ভাষণ আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সিরাজুল আলম খান


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর