খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু— রেলের বগিতে দেশ ঘুরবে মহাজীবন
৭ মার্চ ২০২২ ২২:২৭
ঢাকা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেমন কেটেছে তার শৈশব, কেমন ছিল তার ছাত্রজীবন, কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতিতে? কেমন করে শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা? আজীবন আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকে টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে কীভাবে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের স্থপতি? সেই গল্পই শোনাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বাংলার মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের যে জীবন, বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের সেই মহাজীবনের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে।
এ জন্যই রেলের বগিতে নির্মাণ করা হয়েছে জাদুঘর, যেখানে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন বিভিন্ন ঘটনা। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এই জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রামের চিত্রের মাধ্যমেই উঠে এসেছে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসও।
রেলপথ বিষয়ক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, নতুন প্রজন্মের কাছে সত্যিকারের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়াই এই জাদুঘরের উদ্দেশ্য, যেন তরুণ সমাজ দেশকে ভালোবেসে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে রেলের বগিতে ভ্রাম্যমাণ এই জাদুঘর নির্মাণ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একটি মিটারগেজ ও একটি ব্রডগেজ কোচে গড়ে তোলা হয়েছে একই ধরনের দুইটি জাদুঘর। বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর নির্মিত তথ্যবহুল ও মনোমুগ্ধকর ১২টি পৃথক তথ্যচিত্র ও দুর্লভ আলোকচিত্রের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে এই জাদুঘর। এতে ঢুকেই দর্শক পরিচিত হবেন জাতির পিতার শৈশবের দিনগুলোর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন, রাজনীতিতে হাতেখড়ি, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে গণমানুষের নেতা হয়ে ওঠার গল্প পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হয়েছে এ জাদুঘরে।
কোচের এক পাশের দেয়ালে ছয়টি ডিসপ্লেতে স্থান পেয়েছে ছয়টি তথ্যচিত্র। শিরোনাম রাখা হয়েছে— কিংবদন্তির প্রথম প্রহর, ধ্রুবতারার প্রথম কিরণ, নক্ষত্র হওয়ার পথে, বাংলার মাটি ও ভাষার বঙ্গবন্ধু, ধূমকেতু থেকে নক্ষত্র এবং মুক্তির স্বপ্নের সূচনা। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত তুলে ধরা এই তথ্যচিত্রগুলোতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে পর্যায়ক্রমে তার ছাত্রজীবন, রাজনীতিতে হাতেখড়ি, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে গণমানুষের প্রাণের নেতা হয়ে ওঠা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অবদান, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবর্ণনীয় নির্যাতন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট, মিথ্যা মামলা ও কারাভোগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়।
বগির আরেক দেয়ালে রয়েছে আরও ছয়টি তথ্যচিত্র। শিরোনাম— দুর্বার পথচলা, নিপীড়িতদের কাণ্ডারি, এক নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, মুক্তি-সংগ্রাম ও স্বাধীনতার কথা, স্বপ্নগড়ার দিনগুলো এবং যে আলো নেভেনি আজও। এই তথ্যচিত্রগুলোতে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, গৌরবজ্জ্বল একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের প্রধান নায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদান দর্শকদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে।
কোচের এক প্রান্তে রাখা একটি বড় এলইডি মনিটরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ও সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন দর্শকরা ভালোভাবে শুনতে পান, তার জন্য হেডফোনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
https://youtu.be/4h7gB7rlmuM
রেলপথ বিষয়ক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রেলকে জনগণের বাহন উল্লেখ করে এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, যাতায়াতের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য ভ্রমণের জন্য সাধারণ মানুষ রেলকেই বেশি পছন্দ করে। দেশের ৮০ শতাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে রেলের যোগাযোগ রয়েছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময় তাই আমরা যতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, তার মধ্যে রেলের বগিতে এই ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর নির্মাণ অন্যতম। রেলের মিটারগেজ ও ব্রডগেজ বগিতে নির্মাণ করা জাদুঘরটি সম্পূর্ণভাবে জাতির পিতাকে ঘিরেই করা হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনা, সেগুলোকে নিয়েই সজিয়ে তোলা হয়েছে এই জাদুঘর।
এমন উদ্যোগ হাতে নেওয়ার কারণ তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য একটাই— নতুন প্রজন্ম যেন সত্যিকারের ইতিহাস জানতে পারে, দেশকে ভালোবেসে যেন তারা সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা— তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষার্থীরা এই জাদুঘর থেকে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর জীবনসহ স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস জানতে পারবে। এতে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম গড়ে উঠবে। তারা দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে দেশের জন্য কাজ করার উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পাবে।
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত জাদুঘরটিতে আরও রাখা হয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের আদলে তৈরি একটি বুক শেলফ, যেখানে স্থান পেয়েছে প্রায় একশ বই। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা বই ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইও রয়েছে সেখানে। শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর লেখা বইও আছে। ‘যাদু মনি’ সম্বোধন করে মেয়ে হাসু তথা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠিসহ মোট ছয়টি চিঠির প্রতিলিপি রয়েছে জাদুঘরে, যা বঙ্গবন্ধুকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে দর্শনার্থীদের। আরও রয়েছে জাতির পিতার ব্যবহৃত পোশাক ও বিভিন্ন দ্রব্যের প্রতিকৃতি। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল ও স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতিও।
দর্শকদের নজর কাড়তে এই জাদুঘর তথা রেলের বগির ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম ফুলের বাগান। কোচের ভেতরেই কেবল নয়, বাইরের অংশটিও চোখ জুড়াবে। এখানে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামের ধারাবাহিকতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শিল্পীর তুলিতে।
রেলপথমন্ত্রী সুজন জানালেন, এখন মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত এই জাদুঘর। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিগগিরই এটি উদ্বোধন করবেন। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরীও জানালেন একই তথ্য।
জাদুঘর তৈরির এই কাজে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত মঞ্জুর উল আলম সারাবাংলাকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতোই রেলপথ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। সেটি করতে গিয়েই আমার মনে হয়েছে, বেশিরভাগ কার্যক্রমই অস্থায়ী। এর বিপরীতে স্থায়ী কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়, সেটি ভাবতে গিয়েই রেলের কোচে বঙ্গবন্ধুর জীবনীকে প্রতিপাদ্য করে জাদুঘর নির্মাণের ধারণাটি মাথায় আসে।
রেলওয়ের এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, দেশের ৮০ শতাংশ রেলওয়ে স্টেশন একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। সে কারণে আমাদের মনে হয়েছে, এরকম একটি জাদুঘর করলে সেটি রেলের মাধ্যমে রাজধানী বা শহরাঞ্চলের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও আমরা নিয়ে যেতে পারব। এর মাধ্যমে আমরা ওইসব এলাকার মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর জীবনকে তুলে ধরার সুযোগ পাব। সেই চিন্তা থেকেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির আগেই এটি নিয়ে আমরা আলোচনা করলেও মহামারির কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হয়। তারপরও আমরা গত দুই বছরে একটি ব্রডগেজ ও একটি মিটারগেজ কোচে বঙ্গবন্ধুর জীবনীর ওপর ভিত্তি করে একইরকম দুইটি জাদুঘর তৈরি করেছি।
মঞ্জুর উল আলম আরও বলেন, এই জাদুঘরে রাখা তথ্যচিত্রগুলো দেখলে বঙ্গবন্ধুর কর্মময় যে বিশাল জীবন, তা পুরোটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে দর্শনার্থীর কাছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর বই, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠি— সবকিছু মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য একটিমাত্র স্থানে এত আয়োজন খুব একটা পাওয়া যায় না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শহরকেন্দ্রিক অনেক উদ্যোগ থাকলেও গ্রামের মানুষের কাছে তাকে তুলে ধরার খুব একটু উদ্যোগ আমরা দেখিনি। আমরা সেই সুযোগটিই করে দিতে চাই।
রেলের এই কর্মকর্তা বলেন, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করে আমরা দেশের বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশনে এই জাদুঘর নিয়ে যাব। আমরা সেখানকার মানুষদের জাদুঘর দেখতে আমন্ত্রণ জানাব। সারাদেশে যেন আমরা এই জাদুঘর নিয়ে যেতে পারি, সে কারণেই ব্রডগেজ ও মিটারগেজ— দুই ধরনের রেলের বগিতেই এই জাদুঘর করেছি। আমাদের বিশ্বাস, রেলের বগির এই জাদুঘরের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরাও বঙ্গবন্ধুকে আরও নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ পাবেন।
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু জাদুঘর বাংলাদেশ রেলওয়ে রেলের বগিতে জাদুঘর শেখ মুজিব শেখ মুজিবুর রহমান