জ্বালানির পর এবার উত্তপ্ত খাদ্যপণ্যের বাজার
৮ মার্চ ২০২২ ২০:১০
ঢাকা: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এরই মধ্যে বিশ্ব জ্বালানির বাজার প্রচণ্ড উত্তপ্ত করে রেখেছে। যার কম বেশি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জ্বালানি আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে। যদিও বাংলাদেশে সে আঁচ এখনো লাগেনি। কিন্তু ভবিষ্যত সংকট মোকাবিলায় এখনই অতিরিক্ত জ্বালানি আমদানির উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এবার নতুন আশঙ্কা ওই দুটি দেশ থেকে যেসব খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হয় সেসবে প্রভাব পড়তে পারে। ইউক্রেন-রাশিয়া দুই দেশ থেকেই গম আমদানি করে বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশে গমের চাহিদা খাদ্য তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। পাশাপাশি আমদানির তালিকায় রয়েছে মশুর ডাল, মটর ডাল, ভুট্টা, সরিষাসহ কয়েকটি তৈলবীজ জাতীয় শস্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এসব পণ্যের সংকট তৈরি হতে পারে। এই আশঙ্কার মধ্যেই দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর এ জন্য ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য দেশ থেকে মজুত বাড়ানোর পরামর্শ খাদ্য বিশেষজ্ঞদের।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বে যেসব দেশ গম আমদানি করে থাকে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে বাংলাদেশে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্যের প্রয়োজন হয় তার মধ্যে রয়েছে ৫৮ লাখ টন গম। এর মধ্যে দেশে গম উৎপাদন হয় ১২ লাখ টনের কিছু বেশি। ফলে মোট চাহিদার চার-পঞ্চমাংশ পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরের ১ মার্চ পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে সাড়ে ৯ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী চলতি বছরের জন্য কমপক্ষে আরও ৩০ লাখ টন গমের প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মর্কতারা।
জানা যায়, গম রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে ৫০ শতাংশেরও কম গম আমদানি করা হয়। গত বছর ভারতের বাজারে গমের দাম বৃদ্ধি এবং চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেন-রাশিয়ায় উৎপাদন কম হওয়ায় বাড়তি শুল্ক বসানো হয়। ফলে চাহিদা অনুযায়ী গম আমদানি সম্ভব হয়নি। যার প্রভাব এরই মধ্যে বাজারে পড়েছে। উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ ৫৩ লাখ ৪২ হাজার টন গম আমদানি করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘায়িত হয়, আর গম আমদানি যদি ব্যহত হয় তবে বাজারে তার প্রভাব পড়বে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গেল দুই বছর করোনার কারণে খাদ্য সহায়তা বেড়েছে। যে কারণে চাল-গমের ওপর ভীষণ রকমের চাপ রয়েছে। গত অর্থবছরে দেশের বাজার থেকে ধান চাল সংগ্রহ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। যে কারণে আমদানির পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু বাজারে মূল্য বাড়ানোর কারণে গমের চেয়ে চালের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে বাজারে আটা-ময়দার দাম কয়েক মাস ধরে বাড়তি রয়েছে।
আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রণ দফতরের সূত্র মতে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে একশ’ কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাশিয়া থেকে গমের পাশাপাশি মটরের ডাল, সরিষা, তিসি দানা, মসুরের ডাল, ভুট্টা ও তুলা আমদানি করা হয়। আর ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হয় গম, মটরের ডাল, মসুর ডাল এবং সাদা সরিষা। জানা গেছে, বাংলাদেশ অন্যান্য ফসলের চেয়ে এই দুই দেশ থেকে গম আমদানি করে বেশি। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সরবরাহ। ফলে শিপমেন্ট স্থবির রয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও প্যাকেজিং খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির সঙ্গে আপাতত বাণিজ্য চলমান রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য আমদানিকারকরা বিকল্প সোর্সের অনুসন্ধানে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে যে গম বাংলাদেশে আসে তার মান অতটা ভালো না। এটা লো প্রোটিন। আমরা যারা ময়দা তৈরি করি তার গম আসে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গমের মূল্য বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে প্যাকেজিং খরচ। সেইসঙ্গে বেড়েছে গমের আমদানি মূল্যও। এই দুই পর্যায়ের খরচ সমন্বয় করতে ভোগ্যপণ্য কোম্পানিগুলোকে দামের কথা নতুন করে চিন্তা করতে হচ্ছে।’
এদিকে আন্তজার্তিকভাবে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় দেশের বাজারে প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জে গত এক সপ্তাহে প্রতিমণ গমের দাম অন্তত ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে আটা-ময়দার দাম প্যাকেটপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা করে বাড়তি। বাড়ছে বেকারি পণ্যের দামও। বাড়তি রয়েছে সূর্যমুখী তেল ও ভুট্টার দামও। যদিও দেশের সবচেয়ে বড় আমদানি ও খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারকদের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব এখনও বাজারে পড়তে শুরু করেনি।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বাজারে আটা-ময়দার দাম যুদ্ধের কারণে বাড়েনি। করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর গোটা বিশ্বেই কম-বেশি খাদ্য সংকট রয়েছে। ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়াসহ যেসব দেশ থেকে আমরা খাদ্যপণ্যের উপকরণ আমদানি করে থাকি প্রতিটি দেশই নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। কেউ মহামারি, কেউ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত। যে কারণ সরবরাহও নিম্নমুখী। ফলে বর্তমানে সব পণ্যেরই দামই কিছুটা বেড়েছে।’
এদিকে, গমের পাশাপাশি দেশে বছরে যে ভুট্টার চাহিদা রয়েছে তার ২০ শতাংশ আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা রাশিয়ার ওপর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরাসরি পণ্য কেনা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এ প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে আন্তজার্তিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সবচেয়ে বাড়তি রয়েছে। সরবরাহ ব্যহত হওয়ায় বাড়ছে গমের দামও, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়া বাড়তে পারে সারের দামও। ফলে ভবিষ্যতে বেড়ে যাবে ধান চাষের খরচও। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।’ ভবিষ্যত সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য উৎস থেকে খাদ্যপণ্য সংগ্রহের পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে আমদানি করা গমের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ফলে এই দুটি দেশ থেকে গমের আমদানি কম হলেও অন্যক্ষেত্রে ক্ষতি এড়ানো কঠিন। তাই সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু সরবরাহ বন্ধ রয়েছে, সেহেতু কম-বেশি প্রভাব পড়বে। তবে বাংলাদেশও প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ তিনি জানান, শিগগিরই দুই লাখ টন গম আমদানি করা হবে। সেজন্য বুলগেরিয়ার সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি রয়েছে। আবার ভারত থেকেও গম আমদানি করা হবে।
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য ভাত হলেও গম জাতীয় পণ্য থেকে তৈরি আটা-ময়দা এবং সেগুলো থেকে তৈরি বেকারি, ফাস্টফুডের চাহিদা ব্যাপক। এক্ষেত্রে যাতে বড়ধরনের সংকট তৈরি না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নীতি নির্ধারকরা।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম