আত্মহত্যা ‘মহামারি’ ঠেকানোর উদ্যোগ নেই
২৮ মার্চ ২০২২ ২২:১১
ঢাকা: বাবার সঙ্গে দোকানে যাওয়ার বায়না ধরে ৯ বছরের নুরুল হক নিশাত। দিনমজুর বাবা মাটি ভরাটের কাজ শেষে ছেলের বায়না না মিটিয়ে তার হাতে চিপস দিয়ে চলে যায় দোকানে নাস্তা করতে। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে না যাওয়ায় অভিমানে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে জানালার সঙ্গে গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ৯ বছরের নিশাত। গত ৫ মার্চ দুপুরে নোয়াখালির কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাগধারা বাজারসংলগ্ন সরকারি আশ্রয়ন কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
১১ মার্চ খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি কালাপানি এলাকায় নিজ ঘর থেকে রোমান গাজী (৫০) নামের এক সিএনজি অটোরিকশাচালকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবার বলছে, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন তিনি।
১২ মার্চ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ৯ বছরের মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যার পর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে ৩৬ বছরের সরকারি কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে পারিবারিক কিছু বিষয় নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার ঘটনা।
২০ মার্চ ঢাকার খিলগাঁও ও কামরাঙ্গিরচরে যথাক্রমে ২০ ও ১৫ বছরের দুই মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দু’জনেই বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।
২১ মার্চ প্রেম করে বিয়ের কয়েক ঘণ্টার মাথায় নিজ নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন ২১ বছরের সবুজ মিয়া ও ১৮ বছরের মার্জিয়া জান্নাত। জানা যায়, পেশায় দিনমজুর সবুজ ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী জান্নাতের প্রেমের কথা জানাজানি হলে পালিয়ে বিয়ে করেন তারা। পর মেয়েকে তার পরিবার নিয়ে গেলে দু’জন দু’জনের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন।
২৩ মার্চ রাজধানীর শুক্রাবাদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ বছরের শিক্ষার্থী আকাশ রায় হারপিক খেয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। অভিযোগ প্রেমঘটিত অভিমান। এদিন রাতে টঙ্গীর পাগাড় ফকির মার্কেট এলাকার হাদি পাঠানের বাড়ি থেকে তানিয়া আক্তার (১৭) নামে এক পোশাককর্মীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেদিন সকাল থেকেই তার স্বামী মো. আরিফ নিখোঁজ রয়েছেন। পারিবারিক কলহের জের ধরে তানিয়া আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।
২৪ মার্চ কক্সবাজারের একটি মোটেলে ঝুলন্ত লাশ মিলেছে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ফয়সাল ওরফে হৃদয়ের (২১)। কিছু সময় আগেই তিনি মায়ের মোবাইলে এসএমএস করেছেন, পরিবারের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন- ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণ জানুয়ারির দেড় গুণ, বেড়েছে আত্মহত্যা
একই দিনে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পাম্প অপারেটরের পেছনে ঘুরেও বোরো ধানের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুই কৃষক কীটনাশক পান করেছেন বলে খবর মিলেছে। এর মধ্যে অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) মারা গেছেন। আরেকজন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সারাবাংলা ডটনেটেই চলতি মার্চ মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই ১১ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত পাঁচ দিনেই আত্মহত্যা করেছেন আট জন। আর এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ২৬ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। জানুয়ারি মাসে ছয় জন ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৯ জনের পর মার্চের ২৪ তারিখ পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
এ সংক্রান্ত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছর আত্মহত্যার শিকার এই ২৬ জনের মধ্যে ছয় জনের বয়স ৯ থেকে ১৮ বছর। ১৯ থেকে ২১ বছর বয়সী আছেন আরও ছয় জন। এছাড়া ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী রয়েছেন ৯ জন এবং ৩৫ বছরের বেশি বয়সী পাঁচ জন।
আরও পড়ুন- ফেসবুক লাইভে মাথায় গুলি করে নায়ক রিয়াজের শ্বশুরের আত্মহত্যা
ক্রমাগত বেড়ে চলা আত্মহত্যার এমন প্রবণতাকে ‘মহামারি’ হিসেবে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রুখতে যথাযথ উদোগ্যের ঘাটতি আছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও জরিপের তথ্য বলছে, আত্মহত্যার প্রবণতা করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত বছরের ১৩ মার্চ আঁচল ফাউন্ডেশন এক জরিপের তথ্য প্রকাশ করে। তাতে উঠে আসে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে আত্মহত্যা করেন ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। ওই একই সময়ে দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান প্রায় ৯ হাজার মানুষ। অন্যদিকে ২০২০ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৩১ জন প্রাণ হারান বলে জানায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। তবে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের হিসাবে নিহতের এই সংখ্যা ৪ হাজার ৯৬৯ জন, যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ৬ হাজার ৬৮৬ জন।
তুলনামূলক তথ্য বলছে, ওই সময়ে আত্মহত্যায় প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ছিল করোনা সংক্রমণের প্রাণ হারানো মানুষের প্রায় দেড় গুণ। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের আড়াই থেকে তিন গুণ ছিল আত্মহত্যায় নিহতের সংখ্যা।
আঁচল ফাউন্ডেশনের ওই জরিপ বলছে, মোট আত্মহত্যার ৪৯ শতাংশের শিকার ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা। আত্মহত্যা করা মানুষের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ১৯ বছর। এছাড়া আত্মহত্যার শিকারদের মধ্যে ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ এবং ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৫ শতাংশ।
২০২১ সালে সারাদেশের মোট আত্মহত্যা নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ না করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে একটি জরিপ চালায় আঁচল ফাউন্ডেশন। তাদের সমীক্ষা বলছে, ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬১ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ছিলেন প্রায় ২৩ শতাংশ। এক বছরে এত বেশিসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা এবারই প্রথম বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
আচল থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, স্নাতক তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে বেশি। ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক সামাজিক চাপ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কারণে এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যলয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে প্রেমের সম্পর্ক ও পারিবারিক সমস্যার কথা। এছাড়া মানসিক যন্ত্রণা, পড়ালেখার চাপ এবং আর্থিক সমস্যার কারণেও অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন। কয়েকজনের আত্মহত্যার পেছনে মাদকাসক্তিও কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশন পর্যবেক্ষণে বলছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। ফলে সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়। এতে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় অনেকের মধ্যেই। দেশে এখনো মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় সেই চিকিৎসা সহায়তা না পেয়ে অনেকেই বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের আত্মহত্যার পেছনে কোভিড মহামারিজনিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, কোভিডের সময়ে এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষা প্রভাবে অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হঠাৎ করে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার মুখোমুখি হওয়ায় এসময় পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও একটি ইম্প্যাক্ট তৈরি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার বিভাগের চেয়ারপারসন শান্তা তাওহিদা সারাবাংলাকে বলেন, একে তো আমি মহামারি নয়, অতিমারি বলব। এত অল্প সময়ে এতগুলো প্রাণ হারালাম আমরা। তাও এতগুলো তরুণ প্রাণ। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া অসম্ভব।
দেশে আত্মহত্যাকারীদের বড় অংশই তরুণ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানান অধ্যাপক কামাল ও শান্তা তাওহীদা। অধ্যাপক কামাল বলেন, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোভিড আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গেছেন, তার অন্তত ৬০ শতাংশ বেশি মানুষ মারা গেছেন আত্মহত্যায়। অথচ কোভিড নিয়ে যত সচেতনতা, আত্মহত্যা নিয়ে তার বিন্দুমাত্রও নেই। অন্যদিকে কোভিডে যারা মারা গেছেন, তাদের ৭০ শতাংশেরও বেশি বয়সে পঞ্চাশোর্ধ্ব। নানা ধরনের কো-মরবিডিটিও ছিল অনেকের। কিন্তু আত্মহত্যার শিকার কিন্তু অপেক্ষাকৃত তরুণরা। এই আত্মহত্যা প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ নেই।
এ ক্ষেত্রে আর্থিক অনিশ্চয়তা বড় প্রভাব ফেলে থাকতে পারে বলে মনে করছেন এই ঢাবি অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থীর আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় অনেকেই আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। আর্থিক দুরাবস্থা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিভিন্ন সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় হিসেবে প্রথমত ব্যাপক হারে সচেতনতা তৈরির কথা বলেন দুই শিক্ষক। শান্তা তাওহীদা বলেন, এ সময়ের অনেক তরুণ হতাশার অন্ধকারে ডুবে আত্মহত্যাকে সমাধান ভাবছেন। কিন্তু এটি কোনো সমাধান নয়। শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগ কিংবা মানসিক চাপ থেকেও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। এ ধরনের মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই দেশের সব জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হাতের কাছে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে সচেতনতা ও প্রচারণা কার্যক্রমে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে উদ্যোগের ঘাটতি পূরণ এখন সময়ের দাবি।
অধ্যাপক কামাল বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও জননিরাপত্তা, মানবাধিকার ইত্যাদির ঘাটতি রয়েছে। নেই গুণগত ও গঠনগত উন্নয়ন। আবার আমাদের দেশে এখন সুস্থ বিনোদনের অভাব। নাটক নেই, চলচ্চিত্র নেই, নেই সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের উপস্থিতি। একটি দেশের জাতীয় বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ক্রিকেট হতে পারে না। এসব নানা ফাঁকা স্থানের কারণেই নানারকম উগ্রপন্থি মতবাদেরও বিকাশ হচ্ছে, যা অনেক তরুণকে বিপথগামী করে দিচ্ছে। আবার অনেক তরুণ গঠনমূলক কিছুতে যুক্ত হতে না পেরে হতাশায় ডুবে সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছেন। তাই সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম গড়ে তুলতে হবে, সেগুলোতে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর