আইসিডিডিআর’বিতে রেকর্ড রোগী, সরকারি হাসপাতাল ফাঁকা
২৯ মার্চ ২০২২ ০৯:৫৬
ঢাকা: রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) হাসপাতালে ১৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত দুই সপ্তাহে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৬ হাজার ৩৪৮ জন। একদিকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে যেখানে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি ঠিক তখনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।
সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগীর চাপ না দেখা না গেলেও আইসিডিডিআর’বিতে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে হাসপাতালের বাইরে অস্থায়ীভাবে তাবু খাঁটিয়ে।
গতকাল সোমবার (২৮ মার্চ) সরেজমিনে রাজধানীর আইসিডিডিআর,বিতে এমন পরিস্থিতিই দেখা যায়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, মুগদা, শনির আখড়া, সায়েদাবাদ থেকে শুরু করে টঙ্গী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, আবদুল্লাহপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা আসছে আইসিডিডিআর’বিতে। শুধুমাত্র রাজধানীরই নয়, রোগীরা আসছে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ অন্য জেলা থেকেও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে দুইবার ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে শীতের সময়ে ও গরমের সময়ে রোগীর সংখ্যা বাড়াটা অস্বাভাবিক না। তবে এক্ষেত্রে সবাই যদি এক জায়গাতেই চিকিৎসা নিতে আসে সেটা পরিস্থিতিকে গুরুতর করে তোলে। এমন অবস্থায় সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও যদি রোগীরা চিকিৎসার জন্য যায় তবে আইসিডিডিআর’বিতে চাপ কমে আসতে পারে।
বিগত ২ বছরের পরিসংখ্যান কী বলছে?
আইসিডিডিআর,বি’র ডায়রিয়া চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ১৫ হাজার ৬০৪ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩ হাজার ৭৯২ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও এই সংখ্যা বেড়ে যায় মার্চ মাসে। গেল বছরের মার্চ মাসে ১৮ হাজার ৮২৯ জনকে ডায়রিয়ার চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে এরপরে এই সংখ্যা কমে আসতে শুরু করে এপ্রিল মাস থেকে। এই মাসে ১০ হাজার ৯০৮ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। মে মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র চারদিন কোনো রোগী চিকিৎসা নিতে না এলেও এই ছয় মাসে প্রতিষ্টানটিতে ৪১ হাজার ৪৩২ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
তবে পরিস্থিতি পালটায় ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের পরে। নভেম্বর মাসে ১৪ হাজার ৩৮৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ডিসেম্বর মাসে ২১ হাজার ৩৬১ জন ডায়রিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হয় আইসিডিডিআর’বিতে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৫ হাজার ৯০১ জন ডায়রিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হয় আইসিডিডিআর,বিতে। ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। এই মাসে ১০ হাজার ৩৪৪ জন ডায়রিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ১৫ মার্চ থেকে পালটায় পরিস্থিতি। শুধুমাত্র ১৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত দুই সপ্তাহে ১৬ হাজার ৩৪৮ জন সহ পুরো মার্চে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার ৬৯৯ জন ডায়রিয়া আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া হয় আইসিডিডিআর’বিতে।
এর আগে, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে রোগীর সংখ্যা এমন বাড়ে যা মে মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
পরিস্থিতি কেমন?
আইসিডিডিআর’বির মিডিয়া ম্যানেজার তারিফ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধুমাত্র ঢাকা থেকেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রোগীরা আসছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। অবস্থাটা এমনই যে সবাইকে ভর্তি রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। আর তাই রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ডায়রিয়া মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে প্রটোকল মেইনটেইন করে তাতে আছে আইসিডিডিআর,বি’র অবদান। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে রোগীরা কিন্তু বাসায় মাত্রা অনুযায়ী ওরস্যালাইন গ্রহণ করতে পারে। ডায়রিয়ার তীব্রতা যদি বাড়ে সেক্ষেত্রে অবশ্যই নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারে। কিন্তু যখন সবাই রাস্তার জ্যাম উপেক্ষা করে আমাদের এখানে অসুস্থ রোগীকে নিয়ে আসছে তখন অনেক সময়েই পরিস্থিতি তাদের আরও দুর্বল করে তুলছে। এক্ষেত্রে পাশের চিকিৎসাকেন্দ্রে গেলে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন রোগীরা।’
আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক দূর থেকেও রোগীরা আসছে। নানা বয়সের মানুষেরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। কিন্তু দূর দূরান্ত থেকে যারা আসছেন তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কারণ ডায়রিয়ার কারণে অনেক রোগী এমনিতেই পানি শূন্যতায় ভুগে থাকে। এমন অবস্থায় যখন জ্যামে পড়ে রাস্তায় কারও শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে তখন বিপদের শঙ্কা বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় পানিশূন্যতা বেড়ে প্রায় শকে চলে যাচ্ছে। তীব্র পানিশূণ্যতার কারণে এমনটা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক রোগী আসছে যাদের হয়তো আর কিছু সময় পড়ে আনা হলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়তে পারতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন কিছু ঘটনাও আমরা দেখছি। আর তাই সবাইকে আহ্বান জানাবো প্রাথমিকভাবে যদি শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে তবে ওরস্যালাইন ঘরেই খাওয়ার জন্য।’
পরিস্থিতি যদি আরও খারাপের দিকে যায় তবে অবশ্যই নিকটে থাকা চিকিৎসাকেন্দ্রে কিন্তু যাওয়া প্রয়োজন। আর আমাদের জানামতে বিভিন্ন হাসপাতালে ইতোমধ্যেই ডায়রিয়া কর্নার খোলা হয়েছে, বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রোগী কেনো বাড়ছে?
আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মৌসুম পরিবর্তনের ফলে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়াটা স্বাভাবিক। একইসঙ্গে যদি পানি ফুটিয়ে খাওয়া না হয় তবে এই রোগের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। গরম মৌসুমে জীবাণু তার বেশিক্ষণ বেঁচে থাকার মতো একটা অনুকূল পরিবেশ পায়। আর এ সময়েই দেখা যায় মানুষ আসলে নিরাপদ পানি খাওয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন মাধ্যমে বাইরের পানি পান করে থাকেন। এটা ঝুঁকি বাড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই দেখা যায় রাস্তায় বিক্রি করা বিভিন্ন খোলা খাবার খেয়ে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ফুটানো পানি সবসময় খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এগুলো কিন্তু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাছাড়া হাত ধোয়ার অভ্যাসটা জরুরি। এগুলোর ব্যতিক্রম হলেই বিপদ বাড়তে পারে।’
পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করণীয়?
আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তিনটি বিষয়ে সবসময় বলে থাকি। প্রথমটি হলো যেখান সেখান থেকে পানি খাওয়া যাবে না। পানি যদি খেতে হয় তাহলে সেটি ফোটানো হতে হবে। অন্যথায় নিশ্চিত হতে হবে পানি জীবাণুমুক্ত। অবশ্যই পানি ফুটিয়ে খাওয়া ভালো সবার জন্যেই। দ্বিতীয়ত হাত ধোঁয়া এবং তৃতীয়ত বাইরের খোলা অবস্থায় বিক্রি করা খাওয়া গ্রহণ না করা। এই তিনটি বিষয়ে আমরা সবসময়েই সবাইকে সতর্ক করে থাকি। এগুলো হচ্ছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।’
এরপরেও যদি ডায়রিয়া শুরু হয় তবে তাৎক্ষণিকভাবে ওআরএস শুরু করা। চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে না থাকে ওরস্যালাইনটা খাওয়ার চেষ্টা করা। এটা হচ্ছে প্রতিকারমূলক একটা ব্যবস্থা। এরপরেও যদি অসুস্থতা না কমে বা কেউ যদি স্যালাইন খেতে না পারে, তাহলে কাছাকাছি কোনো হাসপাতালে নিয়ে শিরায় স্যালাইন চালু করতে হবে, বলে জানান এই চিকিৎসক।
এক্ষেত্রে নিকটে থাকা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়াটা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারণ বাসায় স্যালাইন পুশ করা সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে গুরুতর রোগীদের অবশ্যই চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসকদের শরনাপন্ন হওয়াটা জরুরি। এসব ব্যবস্থা না নিয়ে যদি রোগীকে শুধু আইসিডিডিআর’বিতেই নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করে তবে অনেক্ষেত্রেই গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে বিপদ ঘটতে পারে। কারণ এমনটা করে তো আর রোগীর পানিশূন্যতা পূরণ করা যাবে না বরং অধিক গরমে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতির সম্ভাবনা থেকে যায়।’
সরকারি হাসপাতালের কী অবস্থা?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে বহির্বিভাগে যারা চিকিৎসা নিতে আসছেন ও যারা ভর্তি হতে আসছেন তাদের কিন্তু চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে বহির্বিভাগে ৩০ জনের মতো চিকিৎসা নিতে এলেও ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি না। কিন্তু আমরা প্রস্তুত আছি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই।’
একদিকে আইসিডিডিআর’বিতে যখন রোগীর প্রচুর চাপ তখন রাজধানীর আরেকটি বড় হাসপাতাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ডায়রিয়া রোগীর তেমন চাপ দেখা যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রস্তুতি আছে। আটজন শিশু ও দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক এখানে চিকিৎসা নিলেও বাকি বেড আমাদের এখন পর্যন্ত ফাঁকা। তবে আমাদের এখানে চিকিৎসা নিতে আসা সবাইকে আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখানে সবধরণের প্রস্তুতি আছে।’
কী বলছে সিটি করপোরেশন?
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের যেসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে সেগুলো চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক করা হয়েছে আমাদের। তারপরেও আমরা আইসিডিডিআর’বি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা বৈঠকে যোগ দেবো দ্রুতই। এরপরে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করে যাবো বলে আশা করছি।’
তবে সামগ্রিকভাবে প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই বলেই জানিয়েছেন ডিএনসিসির এই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদফতর?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এখানে ডায়রিয়া রোগটা প্রতিবছরই একটু করে বাড়ে। এমন অবস্থায় এবার রাজধানীতে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সামগ্রিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়ার রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া আছে। এর মাঝে সরকারি হাসপাতালগুলোতে খাবার স্যালাইন, আইভি ফ্লুইড স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ রয়েছে। অল্প ডায়রিয়া থাকতেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনকার কাজকর্মে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং সবসময় সুপেয় পানি পান করলে ডায়রিয়া রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। এছাড়াও রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত।’
সারাবাংলা/এসবি/এমও