রোজায় বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ১৫৫০০ মেগাওয়াট, লোডশেডিংয়ের শঙ্কা
২ এপ্রিল ২০২২ ২৩:২৫
ঢাকা: বসন্ত শেষ না হতেই চোখ রাঙাচ্ছে গ্রীষ্ম। প্রখর রোদে এরই মধ্যে জনজীবন হাঁপিয়ে উঠেছে। এদিকে, ইতোমধ্যে এসে গেছে পবিত্র মাহে রমজান। যে কারণে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ইতোমধ্যে গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিং হচ্ছে রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোতেও। তবে গ্রামের তুলনায় ঢাকাতে লোডশেডিংয়ের আওয়ার কম। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এখনই লোডশেডিং শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর রমজান মাসে সেহরি ও ইফতারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে বলে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রে জানা যায়, গ্রীষ্ম মৌসুমে সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। এই সময়ে সেচ কাজ চলমান থাকায় চাহিদা বাড়ে বেশি। এবার এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে রমজান। তার ওপরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপাদান তেল-গ্যাসের দামও বাড়তি। সব মিলিয়ে আসছে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে এ নিয়ে চিন্তিত বিদ্যুৎ বিভাগ।
পাওয়ার সেলের সূত্র মতে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট। ভরা গ্রীষ্মে এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়াতে পারে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। জানা গেছে, ইতো মধ্যে উত্তরাঞ্চলে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। সাধারণত উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কম হওয়ায় গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি লেগেই থাকে। এ কারণে ব্যহত হয় সেচ কার্যক্রম। এ অঞ্চলের একমাত্র তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বড় পুকুরিয়ায় চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন হওয়ায় বিদ্যুতের যোগান অন্য এলাকা থেকে সরবরাহ করতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লোডশেডিং বাড়তির খবর পাওয়া গেছে, রাজশাহী, রংপুর, শেরপুরের দিকেও।
আবহাওয়া অধিদফতরের সুত্র মতে, গ্রীষ্ম না আসতেই তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। ২০ ডিগ্রির নিচে নামছেই না। মাঝে বৃষ্টিপাত হলেও ভ্যাপসা গরম অতিষ্ঠ করে তুলেছে জনজীবন। এপ্রিল-মে মাসে গেল বছরের মতো ৪২/৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গরম বেড়ে গেলে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যাবে। সূত্র মতে, মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৬৫ ভাগেই ব্যবহার করা হয় জ্বালানি। জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ২৫২ মিলিয়ন ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ১১৪ মিলিয়ন ঘনফুট। যা মোট চাহিদার অর্ধেক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার যে সক্ষমতা রয়েছে, তাতে এর থেকে বেশি জ্বালানি সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব না।
এদিকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বিকল্প হিসেবে যে জ্বালানি তেলের ব্যবহার করা হয়, বিশ্ববাজারে যার মূল্য এখন সবচেয়ে বেশি রয়েছে। বেশি দামে তেল কিনে তা বিদুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। আর এর চাপ পড়বে গ্রাহকদের ওপরে। সবকিছু মিলিয়ে গ্রীষ্ম মৌসুমে সেচ ও রমজান মিলিয়ে বিদ্যুতের যে অতিরিক্ত চাহিদা বাড়ছে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যদিও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। সম্প্রতি নিজ দফতরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘২৭০ ডলারের তেল কিনতে হচ্ছে ৭০০ ডলারে। ৩০০ ডলারের এলএনজি কার্গো কিনতে হচ্ছে ১২০০ ডলারে। এ পরিস্থিতিতে সমন্বয় করা কঠিন হয়ে যাবে।’ এ সময় তিনি সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুত ব্যবহারের ওপর জোর দেন।
নসরুল হামিদ বলেন, ‘সব কিছুর দাম বৃদ্ধি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সবার সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে। রোজা আসছে। যখন পুরোপুরি গরম চলে আসবে তখন বিষয়টি বোঝা যাবে। তারাবির সময় দেখা যাবে মসজিদের এসিগুলোতে যে বিদ্যুত ব্যবহার হবে তাতে ১৫০০ মেগাওয়াট লোড অতিরিক্ত নিতে হবে। তাদের প্রতি সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুরোধ জানাচ্ছি। তাতে তাদের বিলও সাশ্রয় হবে।’ উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ভারত বিদ্যুতের দাম তিনগুণ বাড়িয়েছে। আর তেলের দাম বাড়িয়েছে পাঁচগুণ। আমরা এখনও ঠিক আছি।’
জানা গেছে, গেল বছর এপ্রিল মাসে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজার ৭৩৫ মেগাওয়াট। আর চলতি বছর দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। গত বছর রাজধানী ঢাকাতে চাহিদা ছিল ৫ হাজার ৯০৩ মেগাওয়াট। এবার বেড়ে দাঁড়াবে ৬ হাজার ৩১৬ মেগাওয়াট। এভাবে দেশের সবগুলো বিভাগে ৪০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত চাহিদা বাড়তি থাকবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। পাশাপাশি গ্যাসের চাহিদা থাকবে ১৫০০ এমএমসিএফডি।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই ভর্তুকি দিয়ে হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করব। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে। এছাড়া রয়েছে গ্যাস সংকট। এই পরিস্থিতিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মোটামুটি একটা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। যদিও এবার গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে। সেজন্য বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়তি।’ লোডশেডিং ওভাবে হয় না দাবি করে মহাপরিচালক বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের যে খবর আসে তার বেশিরভাগ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে কিংবা এ সংক্রান্ত কারণে। সেটাও সাময়িক। আমরা এরকম হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিতরণ বিভাগের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, ‘গেল বছরের চেয়ে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেশি, অন্যদিকে গ্যাস সংকট। তার ওপরে বেড়েছে গ্রাহক সংখ্যা। যে কাররণে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ লোডশেডিংয়ের আওয়ার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। তবে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট (২৭ এপ্রিল ২০২১)। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ২১ লাখ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী শতভাগ। এছাড়া নির্মাণাধীন ১৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম