চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, তবুও লোডশেডিং
১৫ এপ্রিল ২০২২ ২২:৫০
ঢাকা: ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া থানার প্রত্যন্ত গ্রাম দুধনই। কৃষি প্রধান গ্রামটিতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে বেশ আগেই। কথা হয় গ্রামটির বাসিন্দা প্রদীপ সরকারের (৪৫) সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি জানান, গ্রামটিতে লোডশেডিং সব মৌসুমেই কম-বেশি থাকে। তবে গরমে সবচেয়ে বেশি থাকে। এবার সে মাত্রাও ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। প্রতি দেড়/দুই ঘণ্টা পর পর বিদ্যুৎ চলে যায়। লোডশেডিং এর তথ্য দিয়েছেন একই জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বলা যায় বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে আসে। আর এ পরিস্থিতি গরম আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবার বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার আশে-পাশের এলাকা থেকেও। এদিকে চলতি মৌসুমে বিদ্যুতের যে চাহিদা তার থেকে উৎপাদনও বেশি হচ্ছে বলে জানাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারপরেও কেন লোডশেডিং? বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সরবরাহ ঘাটতির কারণে বেশ কিছু এলাকায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ২২ লাখ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০০ ভাগ। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে ৪৭ লাখ ৩২ হাজার ৪৯টি। সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ। মোট সিস্টেম লস ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বিদ্যুতের এই চিত্রই বলে দিচ্ছে, গত ১৩ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, সাড়ে ২৫ হাজারেরও বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের। তবে গড়ে উৎপাদন হয় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। সোমবার (১১ এপ্রিল) দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ছিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। আর রোববার (১০ এপ্রিল) ছিল দিনে ১১ হাজার ৬১৩ মেগাওয়াট, আর সন্ধ্যায় ছিল ১২ হাজার ৮৫৩ মেগাওয়াট।
জানা গেছে, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াতে পারে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সে হিসাবেও চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি সংকটের কারণে এই সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সবধরনের জ্বালানির দাম বাড়তি। গ্যাস না পেয়ে চালানো হচ্ছে চড়া দামের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে করে শহরের অংশে পুরোপুরি বিদ্যুৎ পেলেও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
সূত্র অনুযায়ী, দেশে মোট ছয়টি বিদ্যুৎ কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রাহক সংখ্যা বেশি আরইবি’র। মোট ৪ কোটি ২২ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৩ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহকই পল্লী বিদ্যুতের। দিনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার অর্ধেকের বেশি ব্যবহার করেন এই গ্রাহকেরা।
তথ্যমতে, সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা আরইবির গ্রাহকরাই বেশি লোডশেডিং পাচ্ছেন। সংস্থাটির বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, এমন এলাকাগুলোতে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল। এছাড়াও লোডশেডিং হচ্ছে- রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটের অনেক এলাকায়। এসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম। আবার জাতীয় গ্রিড থেকেও প্রয়োজনীয় সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে তুলনামূলক লোডশেডিং কম হচ্ছে।
বিতরণ সংস্থা আরইবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তার মধ্য থেকে ৫০০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ঘাটতি থাকছে। যে কারণে দিনে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
এদিকে গত ৭ এপ্রিল রাতে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ১ মেগাওয়াট। অথচ ওইদিনও দেশের অনেক স্থানে বিদ্যুৎ ছিল না। জানা গেছে, ওইদিন ৬৭৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে। গত ৪ এপ্রিল ছিল এ বছরের সর্বোচ্চ লোডশেডিং, যার পরিমাণ ৮৫৪ মেগাওয়াট।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২২ সালের এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে সাড়ে ২৫ হাজারে। উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো সাড়ে আট শতাংশেরও বেশি ঘাটতি থেকে গেছে বিতরণ ব্যবস্থায়। এ প্রসঙ্গে আরইবির চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, ‘মূলত যেসব স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, সেসব জায়গায় কিছু সময় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে।’
এদিকে, ঢাকাতে দু’টি কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ডিপিডিসি ও ডেসকো। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, ডিপিডিসির দিনে সর্বোচ্চ চাহিদা ১ হাজার ৬৭২ মেগাওয়াট, আর ডেসকোর ৯৫২ মেগাওয়াট। এই চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করা যাচ্ছে। তাই ঢাকাতে লোডশিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার সেল’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইতোমধ্যে সবধরনের জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তেল, গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর মূল সমস্যা ওখানেই। সরকার চাচ্ছে গ্রাহকরা যাতে কোনো ধরনের ভোগান্তিতে না পড়ে। সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে, রমজান ও সেচ মৌসুমের পাশাপাশি শুরু হয়েছে প্রচণ্ড গরম। এসব বিষয় মাথায় রেখেই এবার বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াতে পারে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়েছিল, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এর আগে, গত ২৪ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে গ্রাহকদের সাশ্রয়ী হতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সামনে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনও কোনো পরিকল্পনার কথা জানাতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম