মায়ের দাবি— রাজকে ব্রিজ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে
২৩ এপ্রিল ২০২২ ১২:২২
ঢাকা: ‘ছেলেটা আমার ছোট থেকেই শান্ত-শিষ্ট। কখনও কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করত না। বাইরেও তেমন থাকত না। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ ছেলের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করি। আকাশ, নীল, আদিত্য ও শামীমের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়। এরপরে বর্ষা নামে এক মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বন্ধুত্ব থেকে বর্ষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে গড়ে ওঠে। কিন্তু মেয়েটি ওর সঙ্গে প্রেম করত না। ওর প্রয়োজন ছিল টাকার। সে (বর্ষা) নিজে আমাকে এটি বলেছে। কিন্তু ছেলেটা বুঝল না যে, মেয়েটা ওর সঙ্গে প্রতারণা করছে। মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর ছেলেটা দিন-রাত হাতিরঝিলে আড্ডা দিতে থাকে। ওকে অনেকবার সাবধান করেছি। কিন্তু শোনেনি। শেষ পর্যন্ত মারাই গেলো ছেলেটা। ওকে বাঁচাতে পারলাম না।’
ছেলে হারানোর স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন রাজধানীর হাতিরঝিলে ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করা বজলু মিরাজ চৌধুরী ওরফে রাজের মা নাদিরা বেগম। তিনি দাবি করেন— রাজ আত্মহত্যা করার মতো ছেলে না, তাকে হত্যা করে ব্রিজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল রাজ হাতিরঝিলে মহানগর প্রজেক্ট এলাকার ব্রিজ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজ নামে এক যুবক। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মা নাদিরা বেগম পরদিন রাজের প্রেমিকা নুর মির্জা আক্তার বর্ষাকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাজের প্রেমিকা বর্ষাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্ষা বর্তমানে কারাগারে। আগামী ২৯ মে মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য রয়েছে।
রাজের মা নাদিরা বেগম বলেন, ‘কিছুদিন আগে বর্ষা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, আপনার ছেলে আমাকে ডিস্টার্ব করে, পথরোধ করে। আমাকে বিরক্ত করছে। যেভাবে পারেন ওকে আটকান। আমার টাকার দরকার, প্রেমের দরকার না। তখন আমি ওকে বলি, তুমি বন্ধু বা ভাই হিসেবে বুঝিয়ে ওকে বলো। ও যেন এরকম না করে। তখন বর্ষা আমার সঙ্গে বিরক্তিকর আচরণ করে।’
গত ১৪ তারিখ রাত ৯টায় রাজকে ফোন দিই। তখন বর্ষা ফোন ধরে। তাকে আমি বলি, আমার ছেলেটাও বাচ্চা, তুমিও বাচ্চা। রাজকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দাও। বাসায় এলে আমি কথা বলব।
পরে রাজের এক বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে বলে, “আমরা চারজন হাতিরঝিলে বসে আছি। রাজ ব্রিজ থেকে লাফ দিতে পাঁয়তারা করছে, লাফালাফি করছে। ওকে এসে নিয়ে যান। আমি বলি, এখন তো অনেক রাত, আমি একা যেতে পারব না। তখন কিন্তু আমি রাজের কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। রাত ১২টায় বর্ষা আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, রাজের কী অবস্থা। এরপর রাত সাড়ে ১২টায় পুলিশ ফোন দিয়ে বলে, আপনার ছেলে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘ও কি বেঁচে আছে?’ পুলিশ জানায়, ‘সে বেঁচে আছে।’ পরে একা একাই বাসা থেকে যাই। গিয়ে দেখি সাদা অ্যাপ্রোনে আমার ছেলের লাশ মোড়ানো।”
নাদিরা বেগম বলেন, ‘রাজ পানিতে পানিতে লাফ দিয়েছে সেখানে গিয়ে এমন কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না। ওর শরীরে ভেতর কোথাও পানি নেই। আমার সন্দেহ, ওকে মেরে ব্রিজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মুখে রক্তও দেখলাম। আগেই সন্দেহ করেছিলাম, এমনটি হবে। সেটিই হলো। আমার ছেলে আত্মহত্যা করার মতো না। যাদের কারণে আমি ছেলেকে হারালাম তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
মামলা সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা হাজিরঝিল থানার সাব-ইন্সপেক্টর কারিবেল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারি, রাজ ও বর্ষার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রেমঘটিত কারণেই আত্মহত্যার ঘটনাটা ঘটেছে। এ অবস্থায় বেশি কিছু বলতে চাইছি না। তদন্ত শেষে একটা রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে মামলা দায়েরের পরই বর্ষাকে আমরা গ্রেফতার করি। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।’
মামলার অভিযোগে বলা হয়— গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাজের সঙ্গে বর্ষার পরিচয় হয়। পরে বর্ষা রাজকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারপর থেকে রাজ বর্ষাসহ তার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে হাতিরঝিলে আড্ডা দিতো। রাজের কাছ থেকে বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য মানসিক চাপ দিত বর্ষা। বাদীর ছেলে জানকে পারে বর্ষার চরিত্র খারাপ এবং তাকে না জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। বিষয়টি রাজ জানতে পেরে বর্ষাকে ভালো হতে বলে। বর্ষা উল্টো রাজকে বিভিন্ন ধরনের ব্ল্যাকমেইলিংসহ মানসিক নির্যাতন করতে থাকে।
এজাহরে আরও বলা হয়— ভিকটিম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এবং বর্ষার অত্যাধিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে রাজ সব সময় মানসিক চিন্তায় ভুগত।
গত ১৪ এপ্রিল রাত ১০ টার দিকে রাজ বাসার কাউকে কিছু না জানিয়ে বের হয়ে যায়। ১৫ এপ্রিল রাত ৮ টার দিকে বর্ষা বাদীকে ফোন দিয়ে জানায়, রাজ তার বাসায় আছে। তাকে নিয়ে যেতে বলেন বর্ষা। পরে বাদী তার ছেলেকে ফোন দিলে সে ধরে না। পরে রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে রাজের মোবাইল থেকে একটা কল আসে। তখন তিনি জানতে পারেন, রাজ একটি মেয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাগ করে হাতিরঝিলের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। তখন তিনি দ্রুত হাতিরঝিলে থানাধীন মহানগর ব্রিজে গিয়ে রাজকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।
সারাবাংলা/এআই/একে