ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন রাজনীতিবিদরা
২৪ এপ্রিল ২০২২ ০০:১২
ঢাকা: দেশের রাজনীতিবিদরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। এই আইনের ব্যবহারকারী ৮২০ ধরণের পেশার মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজনীতিবিদ ২৫৪ জন। সবচেয়ে বেশি অভিযুক্তও তারাই (৪০.৫৫%)। পাশাপাশি আটকের হারেও সর্বোচ্চ রাজনীতিবিদরা (২৫.৪০%)।
অভিযুক্ত হিসেবে রাজনীতিবিদিদের পরেই আছে সাংবাদিক ২০৭ জন। আটকের ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় অবস্থানে সাংবাদিক (১৮.৭৩%)। ‘অন্তহীন দুঃস্বপ্ন- বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট ২০১৮’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এক গবেষণার ফলাফল হিসেবে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
শনিবার (২৩ এপ্রিল) গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এই ওয়েবিনারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। মুখ্য গবেষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর এবং সিজিএস-এর উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ড. আলী রীয়াজ গবেষণাটির প্রতিবেদন তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এই গবেষণা প্রকল্পটি ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি- এর অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।’
প্রতিবেদনটি গত ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত সরকার অনুমোদিত প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম, অভিযুক্ত বা অভিযুক্তের পরিবার এবং তাদের নিকটজন, অভিযুক্তের আইনজীবী, এবং থানা ও অন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা।
এতে দেখা গেছে জানুয়ারি ২০২০ – ফেব্রুয়ারি ২০২২ সময়কালের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মোট অভিযুক্ত হয়েছেন ২২৪৪ জন, মোট আটক হয়েছেন ৮৪২ জন এবং মোট মামলার সংখ্যা ৮৯০টি। ২৬ মাসের হিসেব অনুযায়ী প্রতিমাসে গড়ে ৮৬ জনের বেশি অভিযুক্ত হন, ৩২ জন আটক হন এবং মামলা হয় ৩৪টির বেশি।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত অভিযুক্ত হয়েছেন ৯১৩ জন, আটক হয়েছেন ২৭৩ জন এবং মামলার সংখ্যা ৪২৬টি। মাসে গড়ে অভিযুক্ত হয়েছেন ৬০.৮৬ জন এবং আটক ১৮ জন।
২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিযুক্তের সংখ্যা ১৩৩১ জন, আটক হয়েছেন ৬০৯ জন এবং মামলার সংখ্যা ৪৬৪টি। মাসে গড়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন ১৪৭ জন করে, আটক ৬৭ জন এবং মামলা হয় – ৫১টির বেশি।
অভিযুক্তদের বয়স বিবেচনায় দেখা গেছে তরুণরাই এই মামলার দ্বারা সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হন। ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদেরও অভিযুক্ত করা হয়। আটকদের মধ্যে ছাত্রদের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।
সিজিএস-এর চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ওয়েবিনারটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.), সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)- এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, এবং আর্টিকেল নাইনটিন- এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিকদের অবস্থান তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, এই আইনের আওতায় সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত এবং আটক হয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা এই আইনে অভিযুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আটক হন। এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও রয়েছেন ভুক্তভোগীর তালিকায়। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও মামলা করে থাকেন, যেমন- আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের সমর্থন আছে এই রকম মামলার পরিমাণ ৩০.৩১%।’
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘এই আইন ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার। অভিযোগকারীর মধ্যে যাদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে বলে চিহ্নিত করা গেছে তার মধ্যে ১৬৭ জন, অর্থাৎ ৮১ শতাংশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। অভিযোগকারী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা বেশি। এজন্য স্থানীয় সাংবাদিকরা এই আইনের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে ২৫ এবং ২৯ ধারায় এবং সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত রয়েছে ৩৫ ধারায়। এই ধারাগুলোর অপব্যবহার রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করেছে।’
প্রধানমন্ত্রীর অবমাননার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে ৯৮টি, মন্ত্রীর অবমাননার মামলা করা হয়েছে ৫১টি এবং রাজনৈতিক নেতাদের আবমাননার মামলা করা হয়েছে ৭৫টি। ফেসবুকে মতামত প্রকাশের জন্য এই আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে ৩৯৯টি। দেশে বিগত ৯ মাসে এই আইনের অধীনে মামলা এবং আটকের সংখ্যা উল্লেখজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। যেহেতু আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়েছে সেহেতু মন্ত্রী চাইলেই তার দায় এড়াতে পারেন না, বলা হয় ওয়েবিনারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)। তিনি বলেন, ‘সরকারের মধ্যে ক্ষমতা হারানোর যে শঙ্কা কাজ করে সেই শঙ্কা থেকেই সরকার নিজেদের সুরক্ষার জন্য এই আইন প্রণয়ন করেছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাষ্ট্রে সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের যে অধিকার দেওয়া হয়, কর্তৃত্ববাদী সরকার আইন প্রণয়ন এবং সেসকল আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের এই অধিকার হরণ করে। এ সকল আইন যে যার বিরুদ্ধে চায়, তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে নিজের ইচ্ছামত। ফলে শাসকগোষ্ঠী আইনকে এক প্রকার অস্ত্রে রূপান্তরিত করে ব্যবহার করে। বর্তমানে আইন প্রণয়ন করা হয় ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, ‘আমাদের এই অন্তহীন দুঃস্বপ্ন চলমান রয়েছে ২০০৯ সাল থেকে। জনগণ প্রত্যেকে প্রত্যেকের ডাটার মালিক, ডাটা জনগণের সম্পত্তি। এই সম্পত্তির কোনো নিশ্চয়তা না দিয়ে এই সব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে চালাকি করে সরকারের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে।’
আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে সবকিছুর জন্যই আইন প্রয়োজন। কিন্তু সেই আইন কোনো বিশেষ মতাদর্শকে অথবা সরকারি দলকে রক্ষা করার জন্য নয়- বরং আইন প্রয়োজন জনগণকে রক্ষা করার জন্য। দেশে যে নতুন ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট এবং ওটিটি অ্যাক্ট আসছে, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- এর চেয়েও ভয়াবহ।’
গবেষণার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘গবেষণায় উঠে এসেছে ১৮ বছরের কম বয়সীদেরকেও এই আইনের আওতায় অভিযুক্ত এবং আটক করা হয়েছে। শুধু এই ১৮ বছরের নিচের নাগরিকদেরকে নয়, এই আইনের আওতায় গৃহবধূকেও আটক করা হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই স্বেছাচারী ব্যবহার নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে।’
সিজিএস-এর চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সাইবার স্পেসের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত ৯ মাসের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- এর অধীনে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেভাবে নারী এবং শিশু নির্যাতন আইন- এর অপব্যবহার হয়েছে, ঠিক একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- এরও অপব্যবহার বেড়ে যাবে।’
সরকারের মন্ত্রীদের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রীরা এমনভাবে কথা বলেন যেন এই আইনগুলো নিজে নিজে সংসদে গিয়ে নিজে নিজে পাস হয়ে আসে। মনে হয় এর পেছনে কারও কোনো হাত থাকে না।’ আসন্ন ওটিটি আইনের ফলে আমাদের বাকস্বাধীনতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করে একটি ‘ভালো’ আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে। এই আইনে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হলেও সাংবাদিকদের দমনের জন্যই এই আইন করা হয়েছে বলে মনে হয়।’
সারাবাংলা/আরএফ/এমও