‘ঘর নয়, যেন ফাইভ স্টার হোটেল পেয়েছি’
২৬ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৪০
ঢাকা: ইদের আগে ঘর উপহার পেয়ে আবেগ আনন্দে মেতে উঠলেন গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষরা। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত অঙ্গীকারে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের মানুষদের জমিসহ ঘর দেওয়ার স্বপ্নপূরণে কারও চোখে ছিল খুশির ঝিলিক, কারও চোখে আনন্দ অশ্রু। বিনামূল্যে জমিসহ পাওয়া ঘরেকে কেউ তুলনা করেছেন ফাইভ স্টার হোটেলের সঙ্গে। সেই ঘরে বসে কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য কাঁথা সেলাই করেছেন। সেই কাঁথা প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসাবে নেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে।
উপকারভোগী রহিমা খাতুন প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘বাড়িখান যে এত সুন্দর স্থানের মধ্যে পাইছি! একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্র। বিল্ডিংটা দেখলে মনে হয় ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। আমি মনে করি, আমার বিল্ডিংটা ফাইভ স্টার হোটেল।’
মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) সকালে মুজিববর্ষ উপলক্ষে তৃতীয় পর্যায়ে ৩২ হাজার ৯০৪টি ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদানের ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে ছিল এমনই চিত্র।
আসন্ন ইদের আগে তৃতীয় ধাপে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে ঘর পেয়েছেন আরও ৩২ হাজার ৯০৪ গৃহ ও ভূমিহীন পরিবার। গৃহহীন ভূমিহীন মানুষগুলো প্রধানমন্ত্রীরে উপহার পেয়ে ইদের আগে ইদের খুশি ছিল চোখেমুখে।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল ইউনিয়নের পোড়াদিয়া বালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প, বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের খাজুরতলা আশ্রয়ণ প্রকল্প, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের খোকশাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারার বারখাইন ইউনিয়নের হাজিগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যুক্ত থেকে উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
চট্টগ্রামের আনোয়ারার বারখাইন ইউনিয়নের হাজিগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে উপকারভোগীদের কথা শোনেন শেখ হাসিনা। সেখানে ১ম ধাপে ঘর পাওয়া উপকারভোগী রহিমা খাতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রহিমা খাতুন মতবিনিময় কালে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘ক্যান আছুন ওনে…। আপনাকে সরাসরি দেইখা আপনার লয় কথা বলার ভাষা নাই, আপনারে দেখলে এত যে খুশি লাগে।’
রহিমা বলেন, ‘আমি চার মেয়ে নিয়ে এতদিন ভাড়া বাসাত ছিলাম। অনেক বছর ভাড়া বাসাত থাকার পর আজ একখান বিল্ডিং এত সুন্দর স্থানের মধ্যে পাইছি। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্র। বিল্ডিংটা দেখলে মনে হয় ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। আমি মনে করি, আমার বিল্ডিংটা ফাইভ স্টার হোটেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রায় ৪০জন নিরাশ্রয় মানুষ ঘর পাইছি। সব ছোট বাচ্চাদের আমি আরবি পড়াই। আর এই যে দেখছেন- এটা আমার মেয়ে আনোয়ারা। সরকারি কলেজে পড়ে। এই মেয়ে সব বাচ্চাদেরকে বাংলা, অংক, ইংলিশ এইগুলি শিখায়। সবমিলিয়ে আমাদের প্রায় ১০/১৫ হাজার টাকা ইনকাম হয়। এই ইনকামের থেকে আমি একটা ফ্রিজ নিছি, প্রতিদিন আপনাকে দেখতে পারি না, তাই একটা টিভি নিয়েছি; প্রতিদিন যেন আপনাকে দেখতে পারি।’
রহিমা খাতুন আবেগ আপ্লুত কন্ঠে আরও বলেন, ‘এক খাট নিয়েছি। এখন আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় অনেক ভালো আছি। আপনাদের দেয়া ঘরে বসবাস করে এই দুইটা ক্যাঁথা সেলাই করছি। আপনাকে অবশ্যই অবশ্যই এই ক্যাঁথাগুলি নিতে হবে আমার কাছ থেকে। আমার থেকে মূল্যবান আর কিছু দেওয়ার নাই। এই দুই ক্যাঁথা আমি বসে বসে সেলাই করছি। দুইটা ক্যাঁথা আপনি আমার কাছ থেকে নিবেন।’
আরও পড়ুন:
- ‘আমার কাছে ক্ষমতটা হচ্ছে জনগণের সেবা দেওয়া’
- প্রধানমন্ত্রীর ইদ উপহার, ঘর পেল ৩৩ হাজার ভূমিহীন পরিবার
- ‘আমার জীবনের আয়ু যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পান’
প্রধানমন্ত্রীর গণভবন প্রান্ত থেকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই’। এ সময় তিনি রহিমা খাতুনের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে চুম্বন দেন। রহিমা খাতুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার সন্তানদের জন্য দোয়া কামনা করেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করেন সেই অনুভূতিও প্রকাশ করেন।
সেখানে আরেক উপকারভোগী এয়ার মোহাম্মদ মতবিনিময়কালে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কেমন আছেন? আমি একজন নদী ভাঙা মানুষ, ভূমিহীন। আমার কিছু নাই, ঘরবাড়ি কিছু নাই। আমি জেলের কাজ করি, সাগরে মাছ ধরি। কোনরকম পোলাপান নিয়া ভাত খাই। আমার থাকার জায়গা নাই। একদম নিরাশ্রয় আমি। আমার মা-বাবাও আমারে আশ্রয় দিতে পারে নাই। এই যে আমি একজন জেলে মানুষ টোহানা (বাছাই) করাইয়া আমারে একটা ঘর দিছেন প্রধানমন্ত্রী। আমি অনেক খুশি হইতাছি। আমাক একটা পাকা ঘর দিয়েছেন, দুই শতক জমি দিয়েছেন। অন্তত আমাকে আমার বিবেক অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ২০লাখ টাকার মালিক বানাই দিছেন, আমি অনেক খুশি।’
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পইরা আপনার জন্য খোদার কাছে অনেক প্রার্থনা করব। আপনি দীর্ঘদিন থাকেন। আমার শেষ ইচ্ছা আরেকটা আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমাকে যেখানে ঘর দিয়েছেন, দামি পাকা ঘর, আমরা এখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করব, আপনি যদি এখানে একটু দেখতে আসেন সবাই খুশি হব।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই আমি চেষ্টা করব। যদি পারি আসতে, আসব। আপনারা সবাই ভালো থাকেন। আর আপনারা সবাই খুশি আছেন, এটাই আমার সব থেকে বড় খুশি।’
এ সময় উপকারভোগীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অগ্রিম ইদ মোবারক জানান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকমোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ের পর আমি আনোয়ারার সব এলাকা ঘুরে ঘুরে রিলিফ দিয়েছিলাম এবং সব জায়গায় গিয়েছিলাম। যারা আজ এই ঘর তৈরি করেছেন, শ্রম দিয়েছেন, কাজ করেছেন সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনারা দেখেন, এক একটা মানুষ কত খুশি! তাদের মুখে হাসি এটাই তো সব থেকে বড় পাওয়া।’
সরকারের চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ৩২ হাজার ৯০৪টি বাড়ি ভূমিহীন ও গৃহহীনরা ইদের আগে এই উপহার পেয়েছে। গৃহহীন-ভূমিহীন উপকারভোগী মানুষরা ইদের আগে জমিসহ ঘর উপহার প্রাপ্তির খুশির আনন্দে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকার উপকারভোগীদের হাতে ঘরের চাবি তুলে দেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষের অঙ্গীকার করেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো মানুষ যাতে ভূমি ও গৃহহীন না থাকে। সেজন্য তিনি দুই শতক জমির উপর দুই রুম বিশিষ্ট একটি ঘর উপহার দিচ্ছেন। এসব ঘরের ডিজাইন প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখে নকশা চূড়ান্ত করার অনুমোদন দিয়েছিলেন।
তৃতীয় ধাপে এসব ঘর প্রদানের আগে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়েছেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি পরিবার। তৃতীয় ধাপের আরও ৩২ হাজার ৭৭০টি ঘর নির্মাণাধীন রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, নদী ভাঙণ কবলিত ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যাললয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২২ সালে মার্চ পরআজ অবধি ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪ ভূমিহীন এবং গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিজড়া, বেদে সম্প্রদায়সহ সমাজের পিছিয়ে পড়া ভাসমান বিভিন্ন জনগোষ্ঠীও রয়েছে।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম