রাভেনার পর লিভারপুল-বার্সেলোনা-রটারডামেও সরাসরি জাহাজ
২৮ এপ্রিল ২০২২ ১৬:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্বল্প সময়ে কম খরচে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর সিঙ্গাপুর এবং কলম্বোকে এড়িয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সরাসরি রুট চালুতে আগ্রহী হচ্ছে ইউরোপের একের পর এক দেশ। এর ধারাবাহিকতায় ইতালির পর ইউরোপের আরও তিন দেশে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হচ্ছে।
বন্দরের কমকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিতে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল, স্পেনের বার্সেলোনা এবং নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দর থেকে সরাসরি ৬টি মাদার ভ্যাসেল পৌঁছাবে চট্টগ্রাম বন্দরে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অনুমতি নিয়েছে। পণ্যভর্তি কনটেইনার নিয়ে ১৫ মে থেকে ২২ মে’র মধ্যে জাহাজগুলো তিন বন্দরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় বন্দর শাট ডাউন হয়ে গিয়েছিল। সিঙ্গাপুর-কলম্বো বন্দরে পাঁচ থেকে সাতদিন, চীনের বন্দরগুলোতে ১০ থেকে ১২ দিন, ইউরোপের বন্দরগুলোতে কমপক্ষে ১৫ দিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোতে জাহাজের বার্থিং শিডিউল পেতে ২০ দিনেরও বেশি সময় লেগেছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে আমরা বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। এর ফলে আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে তেমন প্রভাব তৈরি হয়নি।’
‘এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সরাসরি জাহাজ পরিচালনে আগ্রহী হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নতুন নতুন গন্তব্যে সরাসরি জাহাজ চলাচলের সংযোগ স্থাপন হচ্ছে। ইতালিতে সরাসরি পণ্য গেছে। ইউরোপের আরও কয়েকটি বন্দর অনুমতি নিয়েছে। চীনেও সরাসরি পণ্য যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সরাসরি পণ্য পাঠানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’- বলেন বন্দর চেয়ারম্যান।
সূত্রমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশার রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যার ৬০ শতাংশই ইউরোপের ২৭টি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রফতানি হওয়া মোট ৭ লাখ ২৯ হাজার কনটেইনারের মধ্যে ৩ লাখ কনটেইনার গেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে জার্মানিতে গেছে ১৫ শতাংশের বেশি। ইংল্যান্ডে গেছে প্রায় ১০ শতাংশ। স্পেনে গেছে ৬ শতাংশ। নেদাল্যান্ডসে গেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। ইতালিতে গেছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থ বছরের জুলাই থেকে মার্চ মাসে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে। তৈরি পোশাকের অর্ডারের ক্ষেত্রে এ বছরও ইউরোপের সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে।
বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে নানা জটিলতায় অর্ডার অনুযায়ী তৈরি পোশাক নির্ধারিত সময়ে ইউরোপে পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছিল। সেই বাস্তবতায় ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট ঐক্যমতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য নিতে উদ্যোগী হন।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ইতালির সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু হয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তৈরি পোশাকবোঝাই ৯৫২ কনটেইনার নিয়ে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে এমভি সোঙ্গা চিতা নামে একটি জাহাজ। এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির রুটে সরাসরি যাত্রার সূচনা হয়।
এরপর গত ৫ মার্চ এএসটি মাল্টা নামে আরেকটি জাহাজ তৈরি পোশাকবোঝাই কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে গিয়েছিল।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়। ৪৫ বছর পর ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর এড়িয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক কোনো রুটে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। আগে ইউরোপে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর অথবা মালয়েশিয়ার কেলাং পোর্ট হয়ে পাঠাতে হত। এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের বন্দরগুলোতে পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগত অন্তত ৪২ দিন। সরাসরি রুট চালু হওয়ায় সেটি ১৬-১৭ দিনে নেমে আসে।
এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি পণ্য নিতে আগ্রহী হয় যুক্তরাজ্য, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস। লন্ডনভিত্তিক ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার কম্পানি ‘অলসিস গ্লোবাল লজিস্টিকস’ তিনটি মাদার ভ্যাসেল দিয়ে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল ও নেদারল্যান্ডসের রটারডামে সরাসরি সার্ভিস চালু করতে যাচ্ছে। তিনটি মাদার ভ্যাসেল হচ্ছে- এমভি অ্যামো, বিবিসি ফিনল্যান্ড এবং সান আলফেন্সো।
অলসিসের স্থানীয় প্রতিনিধি ফনিক্স শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন সৈয়দ সোহেল হাসনাত জানিয়েছেন, প্রথম জাহাজ আগামী ১৫ মে লিভারপুলের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়বে। জাহাজটি সর্বোচ্চ ২১ দিনে সেখানে পৌঁছাবে। লিভারপুলে বুকিং অনুযায়ী কনটেইনার নামিয়ে একই জাহাজ অবশিষ্ট কনটেইনার নিয়ে যাবে রটারডামে।
অন্যদিকে স্পেনের বার্সেলোনা হয়ে নেদারল্যান্ডসের রটারডামে তিনটি মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি নিয়ে যাবার অনুমতি পেয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক শিপিং প্রতিষ্ঠান ‘কমোডিটি সাপ্লাইজ এজি’। তাদের তিনটি মাদারভ্যাসেল হচ্ছে- এমভি স্পাইস, এমভি অ্যান্ড্রোমেডা এবং এমভি মিউজিক। সেগুলো আগামী ২২ মে থেকে চলাচল শুরু করবে।
স্থানীয় এজেন্ট রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ জানিয়েছেন, তিনটি কনটেইনার জাহাজ দিয়ে সার্ভিস শুরু হচ্ছে। ১৫ থেকে ১৭ দিন পর একটি করে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়বে।
সারাবাংলা/আরডি/এনএস