মহামারি ‘কাটিয়ে’ ফিরল ইদ উৎসব
৩ মে ২০২২ ০০:০২ | আপডেট: ৩ মে ২০২২ ০৮:০৬
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারির তাণ্ডব পেরিয়ে বিশ্ব অনেকটাই শান্ত এখন। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বাংলাদেশেও এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সবশেষ টানা ১২ দিনে করোনায় কোনো মৃত্যুর সাক্ষী হয়নি বাংলাদেশ। নতুন সংক্রমণের শনাক্তর হারও কমছেই, গত ২৪ ঘণ্টায় যা ছিল ১০ জন। এ পরিস্থিতিতেই দীর্ঘ দুই বছরের বিরতি কাটিয়ে ইদুল ফিতরে ইদ ফিরল উৎসব হয়ে। দুই বছর পর ইদের জামাতও ফিরছে ইদগাহ ময়দানে, বিধিনিষেধ নেই কোলাকুলিতেও— করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এসব আয়োজন বন্ধ রাখতে হয়েছিল দুই বছর।
করোনাভাইরাস। মাত্র একটি শব্দ গোটা বিশ্বকে থমকে দিয়েছিল দুই বছরের জন্য। ছাড় পায়নি বাংলাদেশও। বৈশ্বিক এই মহামারির শুরুটা কেটেছে একেবারেই ঘরবন্দি। ফলে ২০২০ সালের ইদুল ফিতর আর ইদুল আজহাও অনেকটাই কেটেছে ঘরবন্দি অবস্থা। ২০২১ সালে সংক্রমণ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ ছিল না। সেই জায়গা থেকে এখন সতর্ক থাকার কথা বললেও চলমান পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ সময়ের সঙ্গে তুলনীয় বলেই মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাই ইদের উৎসবটাও আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে ধরা দিয়েছে এবার। ইদুল ফিতরে তাই উৎসবেই মাতবে গোটা দেশ।
রোববার (১ মে) ২৯ রমজান সন্ধ্যায় দেশের আকাশে কোথাও শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে সোমবার (২ মে) ৩০ রমজান পূর্ণ হয়েছে। মঙ্গলবার (৩ মে) সারাদেশে উদযাপন করা হবে ইদুল ফিতর। তার জন্য মানুষের প্রস্তুতিও শেষ।
রাষ্ট্রপতি–প্রধানমন্ত্রীর ইদ শুভেচ্ছা
ইদুল ফিতর উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণীতে রাষ্ট্রপতি সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই যেন ঈদের আনন্দ সমানভাবে উপভোগ করতে পারে, সেই জন্য মানবতার মুক্তির দিশারি হিসেবে ইসলামের মর্মার্থ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক, বিশ্ব ভরে উঠুক শান্তি আর সৌহার্দ্যে— পবিত্র ইদুল ফিতরে এ আমার প্রত্যাশা।
ইদ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইদ শান্তি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে মানুষ সাম্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক— এটাই হোক ইদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। হাসি-খুশি ও ইদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক। বিশ্বের সব মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হোক— মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
ইদ জামাত ফিরছে ইদগাহে
এদিকে, মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে গত দুই বছর জাতীয় ইদগাহে ইদের জামাত না হলেও এবার এখানে সকাল সাড়ে ৮টায় হবে ইদের প্রধান জামাত। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলে বা অন্য কোনো অনিবার্য কারণে এ জামাত সম্ভব না হলে ইদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে। তাছাড়া বায়তুল মুকাররমে ৫টি ইদ জামাতের সূচিও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সাধারণত জাতীয় ইদগাহে ইদের নামাজ আদায় করলেও এ বছর তিনি বঙ্গভবন দরবার হলে ইদের নামাজ আদায় করবেন। পরিবারের সদস্য ও কয়েকজন কর্মকর্তাসহ সেখানে ইদের জামাত হবে।
এ বছর ইদ জামাত হবে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানেও। এছাড়া রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ইদ জামাতের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।
ইদে বিশেষ আয়োজন, খোলা থাকছে বিনোদনকেন্দ্র
ইদ উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশু সদন, বৃদ্ধ নিবাস, ছোটমনি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয় কেন্দ্র, সেফ হোমস, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্র, দুঃস্থ কল্যাণ ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশন যথাযথভাবে পবিত্র ইদুল ফিতর উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
দুই বছর পর ইদে খোলা থাকছে বিনোদনকেন্দ্রগুলোও। ইদের দিন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনা টিকেটে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন শিশু পার্কে প্রবেশ এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ইদের দিন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা টিকিটে জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল, লালবাগের কেল্লা ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান প্রবেশ এবং তা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে শিশুদের ইদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ইদে দর্শনার্থীদের বরণ করতে প্রস্তুত জাতীয় চিড়িয়াখানাও। এ উপলক্ষে চিড়িয়াখানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।
প্রায় ভোগান্তিহীন ইদযাত্রা
দুই বছর স্বাভাবিক গতিতে ইদ করতে না পারায় এ বছর ইদুল ফিতর উদযাপন করতে এরই মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে গ্রামে ফিরেছেন অনেক মানুষ। গত এক সপ্তাহে কেবল রাজধানী ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় এক কোটি নাগরিক। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও সপ্তাহখানেক আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তখন থেকেই গ্রামমুখী ঢল ছিল রাজধানীবাসীর। ফলে শেষ বেলার ইদযাত্রায় এবারে সড়কে যাত্রীর চাপ ছিল কম। শেষ দুই দিন গাবতলী বাস কাউন্টারগুলোকে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা গেছে। শিমুলিয়া ফেরি ঘাটে চাপ থাকলেও পাটুরিয়া ঘাটে বাসের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা গেছে ফেরিগুলোকে। ট্রেনে কিছুটা চাপ থাকলেও তা অন্যান্য বছরের মতো চরম ভোগান্তিতে রূপ নেয়নি।
পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে থেকেই বাড়ির পথে যাত্রীদের স্রোত থাকায় শেষ সময়ে এসে তাদের ওপরে মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়েনি। তাছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি মহাসড়কেই চলমান সংস্কার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফলে সড়কগুলোতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পেরেছে গাড়ি। তাতে অনেকটাই ভোগন্তিবিহীন ইদযাত্রা করতে পেরেছেন সবাই।
সন্তুষ্ট নন বিক্রেতারা
দুই বছর পর এবারে ইদ মার্কেটও ছিল অনেকটাই জমজমাট। তবে ব্র্যান্ড শপগুলো ক্রেতাদের উপস্থিতি ও বেচাবিক্রি নিয়ে যতটা সন্তুষ্ট, নিউমার্কেট-গাউছিয়া-মৌচাকের মতো মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের মার্কেটগুলোর দোকানিরা ততটা সন্তুষ্টি জানাতে পারেননি। তারা বলছেন, দুই বছর করোনার অভিঘাতে তাদের পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছিল। এবারে প্রত্যাশা ছিল বাড়তি বিক্রির মাধ্যমে তিক্ত অতীত পেছনে ফেলে লাভের মুখ দেখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বেচাকেনার মাত্রা করোনার আগের সময়ের মাত্রায় ফেরেনি বলেই দাবি তাদের।
পর্যটনকেন্দ্রগুলো প্রস্তুত
এদিকে, ইদুল ফিতরের ছুটিতে পর্যটকদের ঢল প্রত্যাশা করছেন পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টরা। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজারের মতো পর্যটনপ্রধান এলাকাগুলোও বাড়তি পর্যটক বরণ করে নিতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। হোটেল-মোটেলগুলো বলছে, এরই মধ্যে তারা বেশকিছু অগ্রিম বুকিংও পেয়েছেন। ইদের পর কয়েকটি দিন তুমুল ব্যস্ততায় কাটবে তাদের।
প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ইদ ঘিরে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে সতর্ক অবস্থানে। দেশের মানুষ যেন নির্বিঘ্নে ইদ উৎসব পালন করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে সক্রিয় রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীতে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের ইদে সুনির্দিষ্ট কোনো হুমকি নেই। সবাই নির্বিঘ্নে ইদ পালন করতে পারবেন। কোথাও কোনো জঙ্গি হামলারও আগাম তথ্য নেই। করোনাকালীন দুই বছর পর সবাই আনন্দে ইদ পালন করতে পারবেন। এরপরও জাতীয় ইদগাহসহ সারাদেশে র্যাব ও পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, দেশব্যাপী ইদ উদযাপন নির্বিঘ্ন করতে র্যাব সদর দফতরে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় ইদগাহের পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া, দিনাজপুরের বড়মাঠ, রাজশাহীর শাহ মখদুম মাঠসহ বড় বড় জামাতগুলোতে র্যাবের নিরাপত্তা টহল টিম কাজ করবে। ইদ জামাতের আকার ভেদে র্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হবে।
সারাবাংলা/টিআর