Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারত থেকে চুক্তির গম আনাই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৬ মে ২০২২ ২৩:৪৪

ঢাকা: গম আমদানিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মোট গমের প্রায় অর্ধেক আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এর পর গম আমদানির সবচেয়ে বড় অংশ আসে কানাডা থেকে। সেটা প্রায় ২৩ শতাংশের মতো। আর ভারত থেকে আসে ১৭ শতাংশের মতো। রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশে গম আমদানি বন্ধ রয়েছে। সেজন্য গম আমাদানিতে ভারত নির্ভরতা বাড়ছে। তবে ভারত সম্প্রতি গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যদিও বলা হচ্ছে, ভারতের গম রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রতিবেশী দেশের জন্য নয়।

এদিকে, ভারতের বিকল্প হিসেবে একাধিক দেশ থেকে গম আমদানির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। বুলগেরিয়ার সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তিও হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে কানাডার কথাও ভাবা হচ্ছে। ভারত যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা যেন প্রযোজ্য না হয়- তা নিয়েও দেনদরবার চলছে। তবে ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে নতুন করে গম আমদানি করা যাবে কি না- তা নিয়ে এখনও অস্পষ্টতা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানিকারকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।

বেসরকারি আমদানিকারকরা বলছেন, ইতোমধ্যে চুক্তি হয়ছে, কিন্তু ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়নি। চুক্তিপত্র অনুযায়ী ভারত থেকে যেন গম আমদানি করা যায়- সরকারকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন পর্যন্ত বেসরকারি আমদানিকারকদের সঙ্গে না বসলেও ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে বসা হবে বলে জানিয়েছেন সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা। গম আমদানির এই সংকট নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিকল্প পাঁচটি সোর্স থেকে গম আমদানির চেষ্টা করছি। সেই সোর্সগুলো সম্পর্কে আমরা এখনও স্পষ্ট তথ্য জানি না। কানাডা থেকে গম আমদানি করা হতে পারে। ভারত থেকে গম আমদানির সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। খাদ্যমন্ত্রী এরই মধ্যে ভারতীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি করে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসার বিষয়টি খাদ্য মন্ত্রণালয় দেখবে। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে গম আমদানির সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেব। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত থেকে গম আমদানির বিষয়টি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে আমরা কাজ করছি।’

জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের এখনও বসা হয়নি। আমরা সামনে তাদের সঙ্গে বসব। আমারা তাদের বিকল্প দেশ থেকে গম আমদানির কথা বলেছি।’ বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানির যে চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী এলসি হয়নি; চুক্তির সেই গম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চুক্তির গম আনার বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নেব। চুক্তি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। কোন আমদানিকারক কতটুকু গম আমদানির জন্য চুক্তি করেছে, তা আমাদের জানতে হবে। তারপর আমরা সেই অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ভারতীয় দূতাবাসকে চিঠি লিখতে পারব।’

খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারি আমদানিকারকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গম আমদানি করে। তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিতে কোনো সমস্যা হলে ভারতীয় দূতাবাস আমাদের সাহয্য করবে বলে কথা দিয়েছে। আমরা বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকারকদের নীতি সহায়তা দিয়ে যাব। আর তাদের (বেসরকারি আমদানিকারক) আমাদের কাছেই আসতে হবে। এখন পর্যন্ত সমস্যা নিয়ে কেউ আমাদের কাছে আসেনি।’

তিনি বলেন, ‘বেসরকারি আমদানিকারকরা এবার ধীরে ধীরে গম আমদানি করেছে। তারা আরও জোরালোভাবে আমদানি করতে পারতো। কিন্তু সেই অর্থে তারা গম আমদানি করেনি।’ ভারতের বিকল্প খোঁজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিকল্প দেশ হিসাবে বুলগেরিয়ার সঙ্গে আমরা চুক্তি করেছি। আমাদের যতটুক প্রয়োজন আমরা ঠিক সেই পরিমাণ আমদানি করব। আমরা এরই মধ্যে সরকারিভাবে পাঁচ লাখ টন গম আমানি করেছি। আরও দুই লাখ টনের জন্য চুক্তি করেছি। আমরা এখন আাগামী মৌসুমের জন্য টেন্ডার করছি।’

বেসরকারি পর্যায়ে শীর্ষ গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে গম আমদানিকারদের কোনো মিটিং হয়নি। সরকার সরকারের মতো করে চেষ্টা করছে। বেসরকারিভাবে আমাদের তো তেমন কিছু করার নেই। আমরা সরকারকে বলব, গম আমদানির ক্ষেত্রে যেসব চুক্তি হয়েছে, সামনে এলসি খোলার কথা ছিল- চুক্তির সেইসব গম আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে যেন তারা আলোচনা করে। যেহেতু ভারত আমাদের প্রতিবেশি দেশ। তারা এক্ষেত্রে অবশ্যই চুক্তির গম হয়তো রফতানি করতে দেবে।

তিনি বলেন, ‘এলসির আগে অন্য দেশের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমন অনেক চুক্তি হয়েছে। এলসি হয়নি, কিন্তু চুক্তি হয়েছে- সেই চুক্তি অনুযায়ী যেন ভারত থেকে গম আমদানি করা যায়, সরকারকে সেজন্য জোর চেষ্টা চালাতে হবে।’ বেসরকারিভাবে ভারতের বিকল্প কোনো দেশ খোঁজা হচ্ছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে গম আমদানিতে আমাদের খরচ কম ছিল। কিন্তু এখন তো নতুন করে চিন্তা করতে হবে। বিকল্প হিসেবে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও কানাডায় চেষ্টা করতে হবে। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতেও দুই মাস পর হয়তো মৌসুম শুরু হবে। সেখানেও চেষ্টা করতে হবে।’

বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিভাগীয় প্রধান ও নির্বাহী পরিচালক (সেলস) মো. রেদোয়ানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কোন আলোচনা হয়নি। আরও দুই মাস আগে থেকেই আমরা বলে আসছিলাম। আলোচনার জন্যে সরকারেরই এগিয়ে আসা উচিত। বেসরকারি পর্যায় থেকে তো আমরা বলতে পারি না, আলোচনায় বসুন।’

তিনি বলেন, ‘খুচরা পর্যায়ে মাসে একবার দাম পরিবর্তন হয়। ভারত থেকে রফতানি বন্ধ হওয়ার কারণে দামে এখনও কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে সামনে দামে পরিবর্তন আসবে। আমাদের কাছে এখন যে মজুত আছে তা শেষ হলেই দামে পরিবর্তন আসবে। তবে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার কারণে যে দাম বাড়বে এমনটি নয়। ভারত থেকে রফতানি বন্ধ হওয়ার কারণে বাজারে গমের সংকট সৃষ্টি হবে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে এমনিতেই সারাবিশ্বে গমের বাজারে অস্থিরতা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ২৫০ ডলারে যে গম কিনতাম এখন তা ৪০০ ডলারেও পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত রফতানি বন্ধ রাখলে আমরা ঝামেলায় পড়ব। বিকল্প দেশ বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানি চেষ্টা করছি। এসব দেশ থেকে আমরা আগেও গম আনতাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- সবাই আগে নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে ব্যস্ত। যে কারণে এখন কেউ গম বিক্রি করতে চাচ্ছে না।’

প্রসঙ্গত, নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা বিবেচনায় গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। তবে দেশটি বলছে, এরই মধ্যে চুক্তি হয়ে থাকলে সেই গম রফতানিতে বাধা নেই। তাছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলোও ভারত থেকে গম নিতে পারবে। রোববার (১৫ মে) ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গম। বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে দেশে। এর মধ্যে দেশে ১১ লাখ টনের মতো গম উৎপাদন হয়। বাকিটা আমদানি করতে হয়।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

আমদানি কানাডা গম আমদানি বাংলাদেশ ভারত রফতানি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর