শিক্ষায় পিছিয়ে; সম্পদে এগিয়ে সাক্কু, রিফাতের নেই নগদ অর্থ

ঢাকা: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ১৫ জুন। এবার নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন পাঁচ প্রার্থী। ২৭ মে সকালে মেয়র পদে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রার্থীদের। রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী প্রার্থীদের মাঝে আনুষ্ঠানিক এই প্রতীক বরাদ্দ দেন। এছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১০৬ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৬ জনের মাঝেও প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এর আগে, গত ১৭ মে কুসিক নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ওই দিন ছয় মেয়র প্রার্থীসহ মোট ১৬৪ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে ১২০ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ৩৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ছিলেন। পরবর্তীতে ২৬ মে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান মেয়র পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। এছাড়াও ১০ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও দুইজন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করেন।

ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লেখ করা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে পাঁচজন মেয়র প্রার্থীর হলফনামা থেকে দেখা গেছে, শিক্ষাগত দিকে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে পিছিয়ে থাকলেও সম্পদ বেড়েছে সাবেক মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কুর।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের নগদ অর্থ না থাকলেও এক কোটি দুই লাখ টাকার জিপ গাড়ি ও ২০ লাখ টাকার প্রাইভেট কার থাকার তথ্য জানানো হয়েছে হলফনামায়।

তবে স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে পদত্যাগ করা নিজাম উদ্দিন কায়সারের কোনো গাড়ি না থাকলেও ফৌজদারি মামলা সবচাইতে বেশি তার বিরুদ্ধে।

অপর দুই প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাশেদুল ইসলামের কোনো গাড়ি না থাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়।

হলফনামা অনুযায়ী মনিরুল হক সাক্কুর দেওয়া তথ্য

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের টানা দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবার লড়ছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। হলফনামায় উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে দুদক ও আয়কর আইনের দুটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অতীতে দায়েরকৃত হত্যাসহ ফৌজদারি ও অন্যান্য আইনে ১০টি মামলা থেকে অব্যাহতি/খালাস পেয়েছেন।

২০১৭ সালের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেওয়া হলফনামার তথ্যের সঙ্গে এবারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাবেক এই মেয়রের নিজের ও তার স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে। ২০১৭ সালে হলফনামায় নগদ ৮৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩০৬ টাকা থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও ২০২২ সালে এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯২ টাকা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৭ সালে সাবেক এই মেয়রের স্ত্রীর ৫৫ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৩ টাকা থাকার কথা এবার টা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২ সালের কুসিক নির্বাচনে মনিরুল হক সাক্কুর স্ত্রীর ৯৯ লাখ ১৩ হাজার ৮২১ টাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়।

২০২২ সালের নির্বাচনের হলফনামায় বাড়ি, এপার্টমেন্ট, দোকান ও অন্যান্য খাতে মনিরুল হক সাক্কুর আয় দেখানো হয়েছে চার লাখ আট হাজার টাকা। এ খাতে নির্ভরশীলদের নিকট থেকে আয় দেখানো হয়েছে ৬৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭৩৬ টাকা। ব্যবসা খাতে নির্ভরশীলদের আয় ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।

হলফনামায় প্রার্থীর শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত হিসেবে তিন লাখ এক হাজার ৬৯৭ টাকা থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মেয়র হিসেবে বার্ষিক সম্মানী ভাতা হিসেবে মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মনিরুল হক সাক্কুর নিজের নামে দুই লাখ ৯৪ হাজার ২৭ টাকা থাকার তথ্য জানানো হলেও তার স্ত্রীর নামে ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭৫৭ টাকা থাকার কথা জানানো হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানিতে দুই লাখ টাকা জমা আছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

মনিরুল হক সাক্কুর নিজের নামে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও স্ত্রীর নামে ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬৪ টাকার সঞ্চয়পত্র থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

মনিরুল হক সাক্কুর যানবাহনের মধ্যে আছে একটি ল্যান্ডক্রুজার জিপ। একইসঙ্গে তার স্ত্রীর নামেও আছে একটি গাড়ি। এছাড়াও তাদের দুই জনের নামে ২০ তোলা সোনা আছে। ইলেকট্রিক ও আসবাবপত্রের মধ্যে আছে এক লাখ ৪৭ হাজার টাকার মালামাল।

মনিরুল হক সাক্কুর স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে নিজের নামে ২০ একর কৃষি জমি ও ১৪৬ শতকের একটি পুকুর, নাল জমি আছে ১০৪ শতক রয়েছে। তার স্ত্রীর নামে আছে ১.২৩ একর জমি। নিজের নামে রাজধানী ঢাকায় পৃথক পাঁচটি স্থানসহ কুমিল্লা নগরীর বজ্রপুর এলাকায় তার জমি আছে ৪১ শতক। স্ত্রীর নামে রাজধানীর বসুন্ধরায় আছে তিন কাঠার প্লট। নিজের নামে ফ্ল্যাট আছে কুমিল্লা নগরীতে দুইটি, স্ত্রীর নামে নগরীর রেসকোর্স এলাকায় একটি বহুতল ভবন ও রাজধানীর ধানমন্ডিতে দোকান রয়েছে। এছাড়া স্ত্রীর নামে নগরীর বজ্রপুর এলাকায় বহুতল ভবন, ঢাকা দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

একইসঙ্গে, তার কোনো দায়-দেনা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়।

হলফনামা অনুযায়ী আরফানুল হক রিফাতের তথ্য

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন পাওয়া নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত শিক্ষাগত যোগ্যতায়- বিএ। ২০০১ সালের একটি হত্যা মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত নন।

তার আয়ের উৎস কৃষি খাত থেকে ১০ হাজার টাকা, বাড়ি, দোকান ভাড়া বাবদ তার বার্ষিক আয় পাঁচ লাখ টাকা। ব্যবসায় থেকে বার্ষিক আয় ১৭ লাখ ১১ হাজার ৮০০ টাকা। তার ব্যাংকে কোনো নগদ টাকা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়।

আরফানুল হক রিফাতের অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ছয় লাখ ১২ হাজার ৪৯৫ টাকা। তার স্ত্রীর নামে আছে ৩৩ হাজার ২০০ টাকা। নিজের নামে পোস্টাল ও বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র আছে ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৪ টাকার।

আরফানুল হক রিফাতের যানবাহনের মধ্যে আছে একটি জিপ গাড়ি, যার মূল্য এক কোটি দুই লাখ টাকা, ২০ লাখ টাকার একটি প্রাইভেট কার আছে।

হলফনামা অনুযায়ী আরফানুল হক রিফাত ও স্ত্রীর সোনা আছে ৫০ ভরি।

আরফানুল হক রিফাতের স্থাবর সম্পত্তির মাঝে আছে— কোটবাড়ি এলাকার সালমানপুরে ১৭ শতক, স্ত্রীর নামে ছয় শতক জমি। ফেনীতে যৌথ মালিকানায় আছে একটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, যার মূল্য ৩০ লাখ টাকা। ঢাকায় তার ৪০ লাখ টাকার একটি ও কুমিল্লায় আছে ৩০ লাখ টাকার (কেনার সময়) একটি অ্যাপার্টমেন্ট।

হলফনামা অনুযায়ী নিজাম উদ্দিন কায়সারের দেওয়া তথ্য

সাবেক ছাত্রনেতা ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে পদত্যাগী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজাম উদ্দিন কায়সার কুসিক নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। এবারের কুসিক নির্বাচনে সর্বকনিষ্ট এই প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বি.কম। নগরীর মনোহরপুর এলাকার বাসিন্দা কায়সারের বিরুদ্ধে বিচারাধীন ফৌজদারি মামলা রয়েছে ৮টি। খালাস পেয়েছেন ৪টি মামলা থেকে। দ্রুতবিচার আইনের একটি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

হলফনামায় নিজাম উদ্দিন কায়সারের বার্ষিক আয়ের উৎস দেখানো হয়েছে, চাকরি থেকে আট লাখ ৪০ হাজার টাকা, অন্যান্য উৎস থেকে আয় দেখানো হয়েছে চার হাজার ৬২৭ টাকা। তার নগদ আছে ৩৮ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৫ টাকা। ব্যাংকে জমা আছে তিন লাখ দুই হাজার ৪৯৭ টাকা। বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আয় ৪০ হাজার টাকা। স্বামী-স্ত্রীর সোনা আছে ৫০ তোলা। ইলেকট্রনিক সামগ্রী আছে এক লাখ ৯ হাজার ও স্ত্রীর নামে ইলেকট্রনিক ও আসবাবপত্র আছে সাত লাখ টাকার।

হলফনামা অনুযায়ী রাশেদুল ইসলামের দেওয়া তথ্য

নগরীর আসাদনগর এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী। তার নির্বাচনি প্রতীক হাতপাখা। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করা এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রার্থীর নগদ টাকার পরিমাণ ৫০ হাজার। ব্যাংকে দুই লাখ ৪২৮ টাকা আছে তার। এছাড়াও অকৃষি জমি আছে ৮.২৫ শতক।

হলফনামা অনুযায়ী কামরুল আহসান বাবুলের দেওয়া তথ্য

হরিণ প্রতীক নিয়ে কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে লড়বেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল। নগরীর দক্ষিণ চর্থা এলাকার বাসিন্দা কামরুল আহসান বাবুলের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা আছে। ব্যবসা থেকে তার বার্ষিক আয় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। নগদ টাকা আছে তিন লাখ ৫০ হাজার। ব্যাংকে আছে পাঁচ হাজার টাকা। ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ও আসবাবপত্র আছে ৪০ হাজার টাকার। অস্থাবর সম্পদ আছে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকার। তিন লাখ ৪০ হাজার টাকার অকৃষি জমি আছে। ১.৭৫ শতক জমির মধ্যে একটি নির্মাণাধীন ভবন আছে।

প্রসঙ্গত, তফসিল অনুযায়ী কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৫ জুন। এবার কুমিল্লা সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে। সিটিতে মোট ভোটার দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ১৭ হাজার ৯২, পুরুষ ভোটার এক লাখ ১২ হাজার ৮২৬।

কুমিল্লা সিটির এটি তৃতীয় নির্বাচন। এর আগে দুই নির্বাচনেই মেয়র পদে ভোটে নির্বাচিত হন মনিরুল হক সাক্কু। প্রথমবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং দ্বিতীয়বার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

সারাবাংলা/এসবি/একেএম

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন টপ নিউজ