মেয়াদ বাকি ১ মাস: বন্ধ ওভারপাসের কাজ, শুরু হয়নি রাস্তাও!
২৯ মে ২০২২ ০০:১৬
রাজশাহী: মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মেহেরচণ্ডি। এর এক পাশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, আরেক পাশে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই পথে চলাচল করে পবা উপজেলাসহ ওই এলাকার হাজারো মানুষ। সেই মানুষজনের চলাচলের সুবিধার্থে মেহেরচণ্ডিতে ঢোকার পথেই নির্মাণ করা হচ্ছে ওভারপাস। সেইসঙ্গে তৈরি হচ্ছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। কিন্তু জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বন্ধ রয়েছে ওভারপাসের কাজ। এতে দুর্ভোগে পড়েছে ওই এলাকা দিয়ে চলাচল করা হাজারও মানুষ।
নগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়ি ললিতাহার থেকে তালাইমারী অক্টোয় মোড় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। বর্তমানে এই সড়কটি রৌদ্রের দিনে ধূলা ও বৃষ্টির দিনে কাদায় ভরা। অল্প বৃষ্টি হলেই সড়কে জমে উঠে পানি। এই সড়ক নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। ওভারপাসের জন্য কাজ শুরু হচ্ছে না এই সড়কের।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ২৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মেহেরচণ্ডি, খড়খড়ি ললিতাহার বাইপাস পর্যন্ত চার লেনের সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। এর মধ্যে রাবি ও রুয়েটের পেছনে রেললাইনের ওপর ৮১০ মিটারের একটি ওভারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে। এই ওভারপাসের উত্তর দিকে কয়েকটি বাড়ি ও দোকানপাট-গ্যারেজের জমির মালিকরা ভূমি অধিগ্রহণের টাকা পান অনেক দেরিতে। তাই দেরিতেই তারা জায়গা ছাড়েন। এতে আটকে যায় পুরো প্রকল্পেরই কাজ। ফলে হাত গুটিয়ে বসে আছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে এখন ওখানকার বাড়িগুলো ভাঙা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দুই পাশে আরসিসি ড্রেন কাম ইউটিলিটি চ্যানেল, নয়টি আরসিসি কালভার্ট, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও টিঅ্যান্ডটি লাইনের কাজ রয়েছে। এসব কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা আরডিএকে তাগাদা দিচ্ছে। তবে কাজ শেষ করা যাচ্ছে না।
এদিকে, জুন মাসেই শেষ হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। ইতোমধ্যে কয়েক দফা এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখন ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের সমাপ্য প্রকল্পের তালিকায় আছে। ফলে আর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় ঠিকাদার কাজ করতে না পেরে বেকায়দায় পড়েছেন।
মেহেরচণ্ডি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওভারপাসের মুখের সামনে কয়েকটি বাড়ি, অটোরিকশা গ্যারেজ ও দোকান ছিল যা ভাঙা হচ্ছে। এর প্রথম বাড়িটি মোজাম্মেল হকের। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের জন্য টাকা পেয়েছি অনেক পরে। টাকা পাওয়ার পর নোটিশ দেয় বাড়ি ছাড়ার। তারপর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে।’
কয়েকটি বাড়ির পর রয়েছে মঈনুদ্দীনের বাড়ি। তার আছে কয়েকটি দোকান এবং অটোরিকশার গ্যারেজ। এসব জমি অধিগ্রহণও হয়ে ভাঙাও হয়ে গেছে। মঈনুদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসক অফিস থেকে জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিপূরণ বাবদ চেক দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা পাওয়ার পর জায়গা ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। আমরা জমি ছেড়ে দিয়েছি। এখন ভাড়া বাড়িতে আছি। তবে এই অধিগ্রহণের জন্য আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে।’
সেখানকার আরেক বাসিন্দা ইব্রাহিম হক। সরাবাংলাকে তিনি জানান, তার দুই কাঠা ভিটার পুরোটাই অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অধিগ্রহণের জন্য দুই বছর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা পান এ বছরের মে মাসে।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওভারপাস এবং এর আশপাশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পড়ে আছে। এসব পাহারা দেওয়ার জন্য আছে নিরাপত্তাকর্মী। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, মাঝে-মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে সরঞ্জামগুলো দেখেন, আবার চলে যান। এখানেই এসব পড়ে আছে শুরু থেকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। ধূলো ও কাদাপানি মাড়িয়ে প্রায় চার বছর থেকে চলাচল করতে হচ্ছে। উঁচু-নিচু রাস্তায় যানবাহনে চলাচল করতে কোমর ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওভারপাসের কাজ শেষ হচ্ছে না। তাই সড়কের কাজও শুরু হচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল মোমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্য সড়কের চেয়ে এই সড়ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ দিন ধরে এই সড়ক ফেলে রাখার কোনো মানে হয় না। ওভারপাসের আগেই এই সড়ক নির্মাণ করা দরকার ছিল।’
এদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, রেললাইনের ওপর প্রথমে ওভারপাসের গার্ডারের উচ্চতা ধরা হয়েছিল সাড়ে সাত মিটার। পরে পশ্চিম রেল কর্তৃপক্ষ আরও উচ্চতা বাড়াতে বললে নয় মিটার করা হয়। এতে ওভারপাসের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। এ কারণে ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ টাকার একটি প্রাক্কলন গত বছরের ১৭ জুন আরডিএতে পাঠানো হয়। সবার টাকা পরিশোধ না করেই জেলা প্রশাসন গত ৬ এপ্রিল শূন্য দশমিক ৮২৮৮ একর জমি হস্তান্তর করতে চায়। কিন্তু টাকা না পাওয়ায় মালিকেরা হস্তান্তর করতে রাজি হননি। এতে কাজও শুরু করা যায়নি। পরে এই টাকা পরিশোধ করা হলেও এখনও শুরু হয়নি ওভারপাস নির্মাণের কাজ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সময় মতো ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ার জন্য কাজ থেমে আছে। এজন্য আমরা আরডিএ’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসেছি। জমির টাকা পরিশোধ হয়েছে। এখন কাজ শুরু করব। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কাজ শেষ করব। ওভারপাস নির্মাণ হয়ে গেলে সড়কের কাজে বেশি সময় লাগবে না।’
ভূমি অধিগ্রহণের চেক পেতে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে এত দেরি হলো কেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জমির মালিকানা স্বত্ব যাচাই করতে সময় লাগে। আমাদের তো সেই সময়টুকু নিতে হবে। আমরা যাচাই করে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েছি। যাদের জমিতে সমস্যা আছে তাদের টাকা দেওয়া হয়নি। তাদের সমস্যা নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। নিষ্পত্তি হলে তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’
এসব বিষয়ে আরডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওভারপাসের কাজ প্রায় শেষের পথে। যেটুকু বাকি আছে তা ভূমি অধিগ্রহণে দেরি হওয়ার কারণে আটকে ছিল। জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে। মেয়াদ বাড়ানোর আর সুযোগ নেই। তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য বলা হয়েছে।’
সারাবাংলা/পিটিএম