সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার সম্পূরক বাজেট পাস
১৩ জুন ২০২২ ২২:৫৭
ঢাকা: বিরোধীদল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের তুমুল বিরোধিতার মুখে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়েছে। সোমবার (১৩ জুন) জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০২২’ পাসের মাধ্যমে সম্পূরক বাজেট পাস হয়। এই বাজেট পাসের মধ্য দিয়ে সংসদ ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অতিরিক্ত ১৭ হাজার ৫২৪ কোটি ৬৪ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয়ের অনুমতি দিয়েছে।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে সম্পূরক বাজেটের অর্থ অনুমোদনের জন্য ২৬টি মঞ্জুরি দাবির উপর ২৩৮টি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে চারটি দাবির ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। এগুলো হচ্ছে- জননিরাপত্তা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বাকি মঞ্জুরি দাবিগুলো সরাসরি ভোটে দেওয়া হয়। অবশ্য সব ছাঁটাই প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০২২’ উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
সম্পূরক বাজেটের আওতায় ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিপরীতে ১৭ হাজার ৫২৪ কোটি ৬৪ লাখ ৫ হাজার টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৫ হাজার ৩০৭ কোটি ৫৬ লাখ ৬১ হাজার টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থ বিভাগ খাতে বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। এর পরেই রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়কে ২ হাজার ৭৪২ কোটি ৩৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। তৃতীয় সর্বোচ্চ খাদ্য মন্ত্রণালয়কে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়। সবচেয়ে কম এক কোটি ১৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
এছাড়া বেশি বরাদ্দ পাওয়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ৫০০ কোটি ৬৯ লাখ ৬ হাজার টাকা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ৭৫ কোটি ৬৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ৭৮ কোটি ২৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ১১০ কোটি ৫৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ৪ কোটি ৮১ হাজার টাকা, আইন বিচার বিভাগ ৭ কোটি ৮১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগে ১৭৮ কোটি ১৬ লাখ ২৯ হাজার টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক হাজার ৯০৮ কোটি ৭১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ খাতে ২৫০ কোটি ৮১ লাখ ১২ হাজার টাকা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ৪৯৭ কোটি ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ৫২ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২৮২ কোটি ৮৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ১৪২ কোটি ৫৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৯১ কোটি ৯৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, শিল্প মন্ত্রণালয়ে ৬২৬ কোটি ৫৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ১২ কোটি ৪২ লাখ ১৬ হাজার টাকা, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ১৪৭ কোটি ৮ লাখ ৫ হাজার টাকা, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৭৫৭ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ১৭২ কোটি ৭১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ৫৪ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার টাকা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ৩৫৩ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৩১ কোটি ৩৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪০১ কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
সাংবিধানিক নিয়ম অনুসারে যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি তাদের হ্রাসকৃত বরাদ্দের জন্য সংসদের অনুমতির কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে কেবলমাত্র তাদের বরাদ্দে সংসদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিত্রে সংসদে এই সম্পূরক বাজেট পাস হয়। সম্পূরক বাজেটের ওপর মোট ২৬টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে ২৩৮টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়। ছাঁটাই প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী, রওশন আরা মান্নান ও পীর ফজলুর রহমান, বিএনপি’র মো. হারুনুর রশীদ, মো. মোশাররফ হোসেন, ও রুমিন ফারহানা, গণফোরামের মোকাব্বির খান এবং স্বতন্ত্র সদস্য রেজাউল করিম বাবলু। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমালোচনার পাশাপাশি সম্পূরক বাজেট বরাদ্দ না দেওয়ার দাবি জানান।
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশ কত বেশি ট্রিগার হ্যাপি তার সাম্প্রতিক সময়ে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই সরকারের আমলে পুলিশ কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী নয়, পরিণত হয়েছে দলীয় বাহিনীতে। এটা হাড়ে হাড়ে টের পাই যখন দেখি এ সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর এই বাহিনী কীভাবে নির্যাতন করে।’
রুমিন ফারহানা বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী হত্যা, গুম করে। একইসঙ্গে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। এটি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মানুষ যেন এই ধরনের বিপদের সময় কোনো আওয়াজ না করে। এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে গেলেও তার বিরুদ্ধে নেমে আসে নির্যাতন।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘রাষ্ট্রের মালিক কারা। রাষ্ট্রের মালিক হলো জনগণ। পৃথিবীর একমাত্র সংবিধান বাংলাদেশের সংবিধান যেখানে প্রথমেই উল্লেখ আছে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। আমরা কি সীমাবদ্ধ রাষ্ট্র, দায়বদ্ধ সরকার গঠন করতে পেরেছি। রাষ্ট্র যদি কোনো অন্যায় করে পুলিশ তখন চুপ থাকে। আর পুলিশ যদি কোনো অন্যায় করে তখন সকল পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ তখন অসহায় হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেখানে জনগণের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আগে মানুষ রাজনীতিবিদদের কাছে যেত, এখন সেখানে আর যেতে পারছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের জনগণের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই পুলিশ জনগণকে কর্মচারী হিসেবে মনে করে। মনে রাখতে হবে দেশের মালিক জনগণ। আমরা হচ্ছে সেই জনগণের প্রতিনিধি অর্থাৎ মালিকপক্ষের প্রতিনিধি। বাকি সবাই কর্মচারী, কেউ কর্মকর্তা নয়। আর যদি কেউ মনে করে পুলিশি রাষ্ট্র জনগণ কর্মচারী সেটা ঠিক হবে না।’
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘পুলিশ বিচার বিভাগের একটি অংশ। পুলিশ যখন সারা দেশে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী হয় তখন নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কতটা নাজুক। পুলিশের সাবেক আইজিপি বলেছেন ক্ষমতাসীনরা চায় পুলিশ তাদের কথামত চলবে। সরকারি দলের অপরাধীদের ধরতে গেলে সরকারের পূর্বানুমতি লাগবে। এই জায়গা থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেরিয়ে আসতে পারব ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাঙ্খিত জায়গায় নিয়ে যেতে পারব না।’
বেগম রওশন আরা মান্নান, ‘পুলিশ বাহিনী ভালো এবং খারাপ দু’টি কাজ করে থাকেন। তবে খারাপ কাজের যদি বিচারের আওতায় আনা হয় তাহলে এটি অনেকাংশে কমে যাবে। প্রয়োজনে জব টেস্টের মাধ্যমে সেটাকে প্রমাণ করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী অবশ্যই কিছু ভালো কাজ করছে। তা না হলে দেশ একেবারেই অচল হয়ে যেত। কিছু খারাপ লোক সব জায়গায় থাকে। তাদের যদি শোধরানো যায় তাহলে আরও ভালো হবে। তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত কি না সেটি প্রজেক্টের মাধ্যমে বের করা সম্ভব।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম