Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমের বাজার চড়া, প্রতিদিন বিক্রি ৬ কোটি টাকা

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৪ জুন ২০২২ ১০:০২

রাজশাহী: কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে ভ্যানে করে আম বিক্রি করছিলেন ৭০ বছর বয়সী আবদুল লতিফ। এসেছেন বাঘা উপজেলার বাজুবাঘা গ্রাম থেকে। নিজের তিনটি গাছে আমের ফলন এসেছিল। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষীরসাপাত ও ল্যাংড়া আম। বেশি দামে বিক্রির আশা নিয়ে এসেছিলেন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বরে।

আবদুল লতিফ জানালেন, খুব ভোরে মানুষ নিয়ে গাছ থেকে আম নামানো হয়েছে। সেখান থেকে ভ্যানে করে বানেশ্বর হাটে এসেছেন আম বিক্রির জন্য। তিন গাছে প্রায় ২৫ মণ আম হয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত মণ নামিয়ে নিয়ে হাটে বিক্রি করছেন। দামও ভালো পাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলাকে আবদুল লতিফ বলেন, ক্ষীরসাপাত আম ৩ হাজার থেকে ৩২০০ টাকা মণ ও ল্যাংড়া আম ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। গত দুই বছর করোনার কারণে আমের দাম না পেলেও এ বছরের আমের দাম বেশি পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার লাভ বেশিই হচ্ছে।

রাজশাহীর বানেশ্বর হাটে আবদুল লতিফের মতো আম চাষি ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা কয়েক হাজার। প্রতিদিন বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাগমারা, পবা নাটোরের বাগাতিপাড়া, লালপুর থেকে আম চাষি, বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা এখানে আম কেনাবেচা করতে আসছেন। এই হাট থেকেই প্রতিদিন বিক্রি আমের বিকিকিনি হচ্ছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার। এছাড়াও রাজশাহীর নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারের আড়ত ও দোকানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১ কোটির টাকার আম। সে হিসাবে রাজশাহীতে প্রতিদিন প্রায় ছয় কোটি টাকার আম বেচাকেনা হচ্ছে।

আমের বাজার নিয়ে বিক্রেতা-ব্যবসায়ীরা খুশি হলেও ক্রেতারা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর আমের বাজার বেশ চড়া। গত দুই বছরে গোপালভোগ ছিল মণপ্রতি ১২শ থেকে ১৬শ টাকার মধ্যে। ক্ষীরসাপাত ও ল্যাংড়ার দামও ছিল কাছাকাছি। কিন্তু এ বছর শুরু থেকেই এর প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে আম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছরে আমের ব্যবসা খুব খারাপ গেছে। এবার আমের ফলনও হয়েছে কম। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সে কারণেই আমের দাম বেশি।

বিজ্ঞাপন

বানেশ্বর হাটসহ রাজশাহী শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গুটি জাতীয় আমের দাম অন্য আমের চেয়ে অনেক কম। এ আম বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১ হাজার থেকে ১২শ টাকায়। গোপালভোগ প্রায় শেষের পথে। তাই তার দাম এখন অনেক বেশি। ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে। ক্ষীরসাপাত ও ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। লক্ষণভোগ প্রতিমণ ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দুধস্বর, কালুয়াসহ কয়েক প্রজাতি আম ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিখ্যাত ফজলি ও আম্রপালি আম আসবে ১৫ জুন থেকে। এ বছর এগুলোর দামও চড়া থাকবে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

বানেশ্বর বাজারের স্থানীয় আড়ৎদার রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বানেশ্বরের আমের আড়তগুলোতে প্রতিদিন কয়েক হাজার ক্রেতা আসছেন। আমাদের এখানে গাছ থেকে না হলে হাট থেকে আম কিনে নিয়ে এসে বিক্রি করছি। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে আম কিনছেন। এই আমগুলো ট্রাক অথবা কুরিয়ারে করে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিদিন এই বাজার থেকে প্রায় ১০০ ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে আম নিয়ে যাচ্ছে।

বানেশ্বর হাটে আমের বেচাকেনা চলছে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে বানেশ্বর এখন গত কয়েক বছরের চেয়ে অনেক বেশি সরগরম। রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকেও ক্রেতারা আসছেন আম কিনতে। ক্রেতা-বিক্রেতা-আড়তদাররা বলছেন, বানেশ্বরসহ প্রতিদিন রাজশাহীতে প্রায় ৬ কোটি টাকার আমের ব্যবসা হচ্ছে। একই কথা বলছেন বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তারাও। তারা বলছেন, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এ মাসে লেনদেন অনেক বেড়েছে। বানেশ্বর বাজারের বিভিন্ন ব্যাংক, এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংও আগের তুলনায় লেনদেন কয়েকগুণ বেশি হচ্ছে।

বানেশ্বর বাজারের বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুঠিয়া উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে বানেশ্বর। এখানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আমের মৌসুমে লেনদেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এবারও তাই হয়েছে। প্রতিদিন আমাদের ব্যাংকে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা লেনদেন হলেও এই সময়ে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে গত বৃহস্পতিবার ও রোববার।’

বানেশ্বর বাজারের মোবাইল ব্যাংকিং দোকানের স্বত্বাধিকারী অজয় দাস বলেন, ‘আমের মৌসুমের আগে দিনে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লেনদেন হতো। এখন সেই লেনদেন প্রতিদিন দুই লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার ও শনিবার ব্যাংক বন্ধের কারণে ৫ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টাকা পাঠানো হচ্ছে। আমি বাদে অন্য ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। আমাদের এখান থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে।’

বানেশ্বর বাজারের ইজারদার ওসমান আলী বলেন, ‘বানেশ্বর আমের মোকাম মধ্যে সবচেয়ে বড়। এখানে আম কিনতে আসছেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। আমরা, বাজার কমিটি ও উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। এই বাজারে ব্যবসায়ীসহ ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।’

বানেশ্বর বাজার বণিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জুবায়ের আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমের জন্য বানেশ্বর বাজার বেশ জমজমাট। বর্তমানে এই বাজারে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে চার থেকে ৫ কোটি টাকার আম কেনা বেচা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাজারের আশপাশের ছোট দোকান ও আড়তগুলোতে আরও প্রায় অর্ধকোটি টাকার কেনাবেচা হচ্ছে প্রতিদিন।’

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর ৯ উপজেলা ও মহানগরে এবার ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৫৯ মেট্রিক টন। সে হিসাবে আমের মোট উৎপাদন হতে পারে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অনেক আম বাজারে চলে এসেছে। ১৫ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা ও বারী-৪, ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতি এবং ২০ আগস্ট থেকে ইলামতি আম নামবে। আম দিয়ে রাজশাহীর অর্থনীতিতে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা যোগ হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার এখন পর্যন্ত ঝড়, শিলাবৃষ্টি কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। বাকি সময়টা দুর্যোগ না এলে যে আম আছে, তা দিয়েই চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। কেননা, গাছে আম কম বলে সেগুলো বেশি বড় হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এবার গাছে আম কম, তাই দাম বেশি। এতে চাষিরা উপকৃত হচ্ছেন। গত দুই বছর করোনা ও লকডাউনের কারণে আমের ব্যবসা হয়নি। এবার দাম একটু বেশি হওয়ায় আম চাষিরা গত দুই বছরের ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে নিতে পারবেন।’

সারাবাংলা/টিআর

আম আমের বাজার বানেশ্বর রাজশাহী

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর