মাদরাসার সিনিয়র ২ ছাত্রই খুন করে মাশফিকে: পিবিআই
১৯ জুন ২০২২ ১৮:৩৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে এক মাদরাসা ছাত্রকে নির্মমভাবে খুনের তিন মাস পর এর রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেফতার করা হয়েছে খুনের সঙ্গে জড়িত ওই মাদরাসার কিশোর বয়সী দুই ছাত্রকে। পিবিআই জানিয়েছে, তুচ্ছ বিষয়ে ক্ষোভ থেকে মাদরাসার ভেতরে ওই ছাত্রকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। খুনের আগে তাকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে বলেও সন্দেহ পিবিআই কর্মকর্তাদের।
খুনের দায় স্বীকার করে দুই ছাত্র রোববার (১৯ জুন) বিকেলে চট্টগ্রামের একটি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। একইসঙ্গে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবেও দুই ছাত্র আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
গত ৫ মার্চ সকালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নে চরণদ্বীপ দরবার শরীফ পরিচালিত আল্লাম শাহসূফী অছিয়র রহমান মাদরাসার দোতলায় স্টোররুম থেকে এক ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ইফতেখার মালিকুল মাশফি (৭) চরণদ্বীপ ইউনিয়নের ফকিরাখালী গ্রামের প্রবাসী আব্দুল মালেকের ছেলে। সে ওই মাদরাসার হেফজখানা বিভাগের কায়দা শাখার ছাত্র ছিল।
এ ঘটনায় মাশফির মামা মাসুদ খান বাদী হয়ে বোয়ালখালী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বোয়ালখালী থানা পুলিশ তিন শিক্ষককে গ্রেফতার করেছিলেন। এরা হলেন- হাফেজ জাফর আহমদ, হাফেজ মো. রুস্তম আলী ও শাহাদাত হোসেন। জাফরকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তবে খুনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। এ অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই।
চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান সারাবাংলাকে জানান, তদন্তভার পাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তিগত কোনো ক্লু নেই, মাদরাসার সকল শিক্ষক ও ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গত ১৪ জুন পিবিআইয়ের একটি টিম মাদরাসায় গিয়ে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার (১৭ জুন) পিবিআই টিমের কাছে তথ্য আসে যে, একজন ছাত্র খুনের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন এবং সে বিষয়টি জানাতে রাজি হয়েছে। অভিভাবকের মাধ্যমে শুক্রবার রাতে ১০ বছর বয়সী হেফজ বিভাগের ওই ছাত্রকে পিবিআই কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ওই ছাত্র জানায়, তার সঙ্গে আরও একজন সহপাঠী ঘটনা দেখেছে। অভিভাবকের মাধ্যমে তাকেও এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই টিম। দু’জনের বর্ণনা অভিন্ন হওয়ার পর তাদের তথ্য অনুযায়ী ঘটনায় জড়িত দুই ছাত্রকে শনিবার আটক করে পিবিআই কার্যালয়ে আনা হয়। দু’জনের বয়স ১৫ বছর। তারা ওই মাদরাসার সবচেয়ে সিনিয়র তিন ছাত্রের মধ্যে দু’জন এবং দুরুদ বিভাগের ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদে দু’জন হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে বলে জানান পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।
হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে পিবিআই টিমের সদস্য পরিদর্শক মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই ছাত্র জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, নিহত মাশফি এবং তাদের বাড়ি একই এলাকায়। মাশফির জন্য তার বাসা থেকে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার পাঠাত। এই দু’জন সেই খাবার জোরপূর্বক খেয়ে ফেলত। মাশফি তার বড় ভাইকে বিষয়টি জানায়। তখন বড় ভাই ক্ষুব্ধ হয়ে মাদারাসায় এসে দু’জনকে বকাঝকা করে এবং তিনি বিষয়টি শিক্ষক জাফরকেও জানিয়ে দেন। জাফরও তাদের ধমক দেয়। এতে দু’জনের ক্ষোভ জমে মাশফির ওপর। সেই ক্ষোভ থেকেই হত্যাকাণ্ড।’
পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ‘ঘটনার দিন মাদরাসায় ক্লাস চলছিল। কিন্তু গ্রেফতার দু’জনের একজন মাশফিকে নিয়ে দোতলায় স্টোররুমে যায়। আরেকজন গিয়ে তাদের সেখানে শুয়ে থাকতে দেখে। আমাদের ধারণা, প্রথমজন মাশফিকে জোরপূর্বক বলাৎকার করেছে। কিন্তু এখন সেটা প্রমাণ করা মুশকিল। বিষয়টি অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকারও করেনি। যা-ই হোক, দ্বিতীয়জন দেখার পর মাশফি লজ্জা পেয়ে বিষয়টি শিক্ষকদের জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। তখন প্রথমজন তাকে ধাক্কা দেয়। মাশফি দেয়ালের সঙ্গে আছড়ে পড়ে। সে মাশফির মাথা ধরে সজোরে দেয়ালের সঙ্গে আঘাত করে। মাশফি লুটিয়ে পড়লে দ্বিতীয়জন হাত-পা চেপে ধরে এবং প্রথমজন জবাই করে হত্যা করে।’
মাশফিকে জবাইয়ে ব্যবহৃত ছোরাটি গ্রেফতার একজনের পোশাকের বাক্স থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান।
পিবিআই পরিদর্শক মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন জানিয়েছেন, মাশফিকে খুনের পর মাদরাসার তিন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হলেও তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। গ্রেফতার দুই ছাত্র ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী দুই সাক্ষীও জবানবন্দি দিয়েছেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম