নাম তার স্বপ্নদ্বীপ!
২০ জুন ২০২২ ১৭:৫৮
ঢাকা: তখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। বাস থেকে নেমে তাই দ্রুত লয়ে এগিয়ে আশ্রয় নিই একটি হোটেলে। সেখানে শুধু ভাতের আয়োজন থাকায় পাশের হোটেল থেকে সেরে নিলাম সকালের নাস্তা। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়ে হেসেছে সূর্য। হোটেল থেকে বেরিয়ে পাশের দোকানে দলবদ্ধ চা বিরতি। গরুর খাঁটি দুধের চা বলে কথা!
সকাল সকাল রাজধানীর গুলিস্তান থেকে বিআরটিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে রওয়ানা হই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বিশনন্দী ফেরিঘাটের উদ্দেশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘সাপ্তাহিক আমাদের আড়াইহাজার’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ জানান, সেখানে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে, আবহাওয়া অনুকূল নয়। আমাদের বাস তখন কাঁচপুর সেতু পেরিয়ে মদনপুরের দিকে। তাই ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অভিযান অব্যাহত। মূল লক্ষ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুরে চরশিবপুরের স্বপ্নদ্বীপ পার্ক ও রিসোর্ট। একপাশে নরসিংদী, একপাশে নারায়ণগঞ্জ এবং আরেকপাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। এই তিন জেলার মোহনায় স্বপ্নদ্বীপের অবস্থান। এটি প্রকৃত অর্থেই একটা দ্বীপ, চতুর্দিকেই মেঘনা নদী। স্থলের সঙ্গে সংযোগ নেই। নৌকা বা ট্রলারই সেখানে যাওয়ার একমাত্র বাহন।
বিশনন্দী বাসস্ট্যান্ডের অদূরেই ফেরিঘাট। সেখান থেকে স্বপ্নদ্বীপে যেতে হয় ট্রলারে। স্রোতের গতিবিধির ওপর ভিত্তি করে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মতো।
ট্রলার চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হলো এমন বৈরী আবহাওয়ায় মেঘনা পার হওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেলো না তো! ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলার টলমল। এ-কাইত ও-কাইত। যারা সাঁতার জানেন, তাদের মুখেও যেখানে শঙ্কার ছায়া, যারা সাঁতার জানেন না মনে হচ্ছে ‘জীবন যেন ষোলো আনাই মিছে’। এ অবস্থায় চোখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় কী? যাক শেষ পর্যন্ত নাগাল পেলাম স্বপ্নদ্বীপের।
ট্রলার থামলো ঘাটে। ওপর থেকে সিমেন্টের সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে মিশে গেছে মেঘনার জলে। এখানে গোছল করতে দেখা গেলো কাউকে কাউকে। পুরো দ্বীপে এমন আরও কয়েকটি স্থানে সিঁড়ির ঘাটলা করা আছে, দর্শনার্থীরা যাতে সেখানে নিরাপদে গোছল করতে পারে সে জন্য।
ট্রলার থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা উঠতেই দ্বীপের প্রধান ফটক। সেখানে রয়েছে টিকিট কাউন্টার। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো বিশাল খোলা চত্বর। পরিকল্পিতভাবে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কটেজ, ক্যাফেটেরিয়া, মসজিদ, অফিস এবং আরও কিছু স্থাপনা। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। ‘চর’ বললেই যেমন চোখের সামনে ভেসে উঠে কেবল ধূ ধূ বালুরাশি, এখানে প্রবেশের পর সেই ভাবনা উবে যাবে। চারিদিকে গাছ লাগিয়ে রীতিমতো বন সৃজন করা হয়েছে।
গাছের ছায়া দিয়ে যতই ভেতরে প্রবেশ করছিলাম, ততই যেন মিশে যাচ্ছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে। বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছিল প্রাণ। এখানে আসার পথে মেঘনার উন্মত্ততা ভুলে যেতে সময় লাগল না। বাতাস যেন মিতালি করেছে বৃক্ষরাজির সঙ্গে। গাছের সঙ্গে গাছের ছোঁয়া যেন বলতে চাইছে অনেক না বলা কথা। গাছ ছুঁয়ে বাতাসের আনাগোনার শব্দে তৈরি হচ্ছে বুক ঝিম এক পরিবেশের, যা ব্যক্ত নয়, অনুভবের বিষয়।
নদীকে ডান দিকে রেখে পুরো দ্বীপে হেঁটে বেড়ানোর সময়কার অনুভূতি ব্যক্ত করা সহজ নয়। ইট-পাথরের নগর জীবনের একঘেঁয়েমি যেন কেটে গেল মুহূর্তেই।
কবিরা হয়ত এমন পরিবেশেই রচনা করে ফেলতে পারেন তার শ্রেষ্ঠ কবিতাটি। নাট্যকার তার নাটক। অন্তরে যার সঙ্গীত, সে হয়তো নিজের অজান্তেই গেয়ে উঠবেন কোন গান। রবীন্দ্রনাথ কি এমন পরিবেশেই লিখেছিলেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’, কিংবা ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ’ কে জানে!
এই এলাকাটি দীর্ঘ সময় চর ছিল, তখন কৃষিকাজ হতো। পরে আয়োজকরা ১০০ বিঘা জায়গা ঘিরে গাছপালা লাগিয়ে, পার্ক, কটেজ তৈরি করে এবং অন্যান্য আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে চর-কে পরিণত করেছেন ‘দ্বীপে’। এ জন্য কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি তাদের!
এমনটাই বলছিলেন স্বপ্নদ্বীপের প্রতিষ্ঠাতা, ঠিকাদার আকতার হোসেন। বললেন, ২০১৮ সাল থেকে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে শুরু করি এই স্বপ্নদ্বীপ তৈরির কাজ। প্রথমে বন্ধু-বান্ধবরা এগিয়ে আসে। পরে আরও কিছু লোকজন জড়িত হয়। এখন স্বপ্নদ্বীপের অংশীদারের সংখ্যা ৩০ জন। প্রথমে শখের বশবর্তী হয়েই এটি করেছি। এখানে একটি বন করেছি। প্রায় সব ধরনের গাছপালাই এখানে রয়েছে। ২৫/২৬ জন কর্মচারী রয়েছে, যারা সার্বক্ষণিক দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ করছেন।
তিনি বলেন, এখানে যে জমি আপনারা দেখছেন সেখানে মানুষ এক সময় চাষাবাদ করতো। আমরা তাদের কাজ থেকে কিছু জমি কিনেছি, কিছু বন্ধক এবং কিছু লিজ নিয়েছি। আমাদের আওতায় থাকা জমির পরিমাণ এখন প্রায় ১০০ বিঘা। চারিদিকে পানি থাকায় এখানে সবসময়ই মনোরম পরিবেশ বিরাজ করে। আছে ক্রিকেট ও ফুটবল মাঠ, দুইটা পুকুর, একটা টিলা। টিলায় উঠলে পুরো দ্বীপের দৃশ্যটা চমৎকার দেখা যায়।
আকতার হোসেন বলেন, রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড ও গুলিস্তান থেকে যদি কেউ এখানে আসতে চান তাহলে বিআরটিসি এসি বাসে আসতে পারবেন। সায়দাবাদ থেকে আসতে পারবেন অভিলাষ বাসে। তাদেরকে প্রথমে আড়াইহাজারের বিশনন্দী ফেরিঘাটে নামতে হবে। তারপর ট্রলারে আসতে হবে।
তিনি বলেন, স্বপ্নদ্বীপে আসার মূল ব্যবস্থা হলো বিশনন্দী ফেরিঘাট থেকে ট্রলারে। তবে কেউ চাইলে ফেরিতে নদী পার হয়ে ওপারে করিকান্দি ফেরিঘাটে নেমে সেখান থেকেও নৌকা বা ট্রলারে আসতে পারবেন। চাইলে দেশের যে কোনো জায়গা থেকে ট্রলার বা লঞ্চে আসা যাবে। কেউ আমাদের সঙ্গে চুক্তি করলে আমরা নিজস্ব নৌকা বা ট্রলারে করে দর্শনার্থীদের আনা নেওয়ার ব্যবস্থা করি। আমাদের নিজস্ব নৌকা ও ট্রলার আছে।
আকতার হোসেন মনে করেন, কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিনের মতো দূর-দূরান্তে যেতে হলে অনেক বড় জার্নি হয়ে যায় এবং ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে দূরের ট্যুরে যাওয়া রিস্ক বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু স্বপ্নদ্বীপ ঢাকার একদম কাছে। তাই আশেপাশের লোকজনের পছন্দের তালিকায় রয়েছে এই দ্বীপ। নারী পুরুষ শিশু অনেকেই এখানে আসেন এবং নির্জনে সময় কাটান। এখানে এলে নৌকা ভ্রমণও হয়, আবার দ্বীপে ঘুরেফিরে সময় কাটাতেও পারে।
এখানে প্রবেশ ফি ৩০ টাকা। সারাদিনই ঘুরে বেড়ানো যাবে। কেউ যদি এখানে খেতে চান, তাহলে আগে থেকে অর্ডার দিতে হয়। তবে ক্যাফেটারিয়া থাকায় চটপটি, চা, নাস্তা সব সময়ই পাওয়া যায়। বিশনন্দী ফেরিঘাটেও খাবার হোটেল রয়েছে। অনেকে পিকনিকের জন্যও এখানে আসেন। যেহেতু এটি একটা দ্বীপ তাই ইচ্ছা করলেই কোনা বখাটে বা দুর্বৃত্ত এখানে এসে কিছু করার সাহস পায় না। কারণ তারা জানে, চারিদিকে পানি থাকায় এখানে কিছু ঘটিয়ে নিরাপদে ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব!
রাতে থাকার জন্য কটেজ আছে। ১৫ জনের কম হলে রাতে থাকার সুযোগ দেওয়া হয় না। কারণ রাতে অতিথি থাকলে তাদের নিরাপত্তায় অনেক বেশি কর্মী নিয়োজিত করতে হয়, এতে ব্যয় বাড়ে। দিনের বেলা কটেজগুলোর ভাড়া ৫০০ টাকা। স্বামী-স্ত্রী হলেও তাদের এনআইডি কার্ড দেখিয়ে ভাড়া নিতে হয়। রাতে থাকলে কটেজ ভাড়া পড়ে ২০০০ টাকা।
কটেজে কিং সাইজ খাট, একটা ফ্যান আছে। তবে অ্যাটাস্ট বাথরুম নাই। তাবুতেও থাকার ব্যবস্থা আছে। ১৫০০ টাকার একটা প্যাকেজ আছে। এর আওতায় রয়েছে, এন্ট্রি টিকেট, ট্রলারে আসা যাওয়া, দুপুরের খাওয়া, রাতের খাওয়া, মাঝরাতে বারবি-কিউ, সকালের নাস্তা এবং রাতে তাবুতে থাকা।
বাচ্চাদের কিছু রাইড আছে। আছে ম্যাজিক বোট, নাগরদোলা ইত্যাদি। এগুলো ব্যবহার করতে ২০ ও ৩০ টাকা করে টিকিট লাগবে। নৌকা চালানো এবং ঘোড়ায় চড়ারও ব্যবস্থা আছে স্বপ্নদ্বীপে।
দিন শেষে ফেরার পালা। আবার সেই ট্রলার এবং উত্তাল মেঘনা পাড়ি দেওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বাতাসের বেগ সকালের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু কিছু করার নেই। ফেরার আর কোনো বিকল্প নেই। স্রষ্টার নাম জপতে জপতে পাড়ি দেওয়া শুরু করলাম উত্তাল মেঘনা।
মাঝ নদীতে আসতেই মেঘনার রুদ্ররূপ। সকালের ঢেউ, এখনকার ঢেউয়ের কাছে কিছুই না। ট্রলারে সবাই বসে আছি, থমথমে পরিবেশ। একমাত্র মাঝির কোনো বিকার নেই। তিনি ঢেউ ভেঙে এগিয়ে চলছেন। ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারে দুলুনি বেড়েই চলেছে। কঠিন সময়ের মুখোমুখি আমরা সাঁতার জানা- না জানার দল। এক সময় পৌঁছে গেলাম বিশনন্দী ঘাটে। সবার মধ্যে যেনে প্রাণ ফিরে এলো। ভাবখানা এমন, এটা কোনো ঢেউ হলো, মামুলি ব্যাপার! অথচ ট্রলারে অবস্থানের ২০ মিনিটকে মনে হচ্ছিল, ‘অনন্তকাল’।
তাই মেঘনা পার হওয়ার সময় বাতাসের গতিবিধির প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। নারী ও শিশু থাকলে এটি ‘ফরজে আইন’!
লেখক: সুমন ইসলাম, বার্তা সম্পাদক, দৈনিক সারাবাংলা
সারাবাংলা/একে