খাদ্য সংকটে বানভাসিরা, তালিকায় আটকে আছে ত্রাণ!
২১ জুন ২০২২ ২১:২৩
সিরাজগঞ্জ: শনিবার (১৮ জুন) রাত ২টা। বন্যার পানি শাহিদা বেগমের ঘরে ঢুকে গেছে। অগত্যা ছাড়তে হবে ভিটা। আশ্রয় নিতে হবে কোনো উঁচু জায়গায়। সেজন্য রাতের অন্ধকারেই নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে যাত্রা। কিন্তু প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি এই বানভাসি। চুলা ভেঙে যাওয়ায় দু’দিন ধরে আগুন জ্বলেনি রান্নার। শুকনো খাবার খেয়ে কোনোরকমে দিন পার করছেন তিনি। শুধু তাই নয়, সখের বশে পালন করা গবাদিপশু নিয়েও পড়েছেন বিপাকে।— এ রকম চিত্র দেখা গেছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের পাঁচঠাকুরী গ্রামের বন্যাকবলিত এলাকায়। তবে এমন পরিস্থিতিতেও এখন পর্যন্ত কেউ বানভাসিদের খবর নিতে আসেনি।
শাহিদার সঙ্গে কথা বলতে দেখে এগিয়ে আসেন জাহানারা বেওয়াসহ কয়েকজন। তাদের অবস্থা শাহিদার মতোই। কন্নাজড়িত কণ্ঠে সবাই বলতে থাকেন, বাড়িঘরসহ সবকিছু বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েকজন প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র আনতে পারলেও অনেকেই পারেনি।
সিরাজগঞ্জে যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে নদীর অভ্যন্তরের চরাঞ্চলগুলো একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের মানুষগুলো। ফলে এলাকার অনেকেই উঁচু বাধ বা নির্মানাধীন কোনো ভবনে ঠাঁই নিচ্ছেন, পার করছেন মানবেতর জীবন। অনেকেই আবার রাস্তার ধারে তৈরি করছেন অস্থায়ী ছাপরা ঘর। এদিকে, সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চলের শত শত একর ফসলি জমি। ডুবতে শুরু করেছে এসব অঞ্চলের বাড়ি-ঘর।
জাহানারা বেওয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছি। তবে রাত হলেই সাপ-পোকার ভয়ে আতঙ্ক বেড়ে যায়। বৃষ্টি হলে উপর দিয়ে পানি পড়ে— এভাবেই খুব কষ্টে দিন পার করছি আমরা।’
একই গ্রামের সালমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বানের পানিতে সবকিছু ডুবে গেছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে বাঁধের উপর উঠেছি। রান্নার করার মতো কোনো কিছুই আমাদের কাছে নেই। দিনে একবার রান্না হলে বাকি দু’বেলা হয় না। স্বামীর এখন কোনো কাজও নেই।’ মেম্বার-চেয়ারম্যানরা খোঁজ নিয়েছেন কি না? জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘তিন/চার দিন ধরে এখানে আছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেয়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছোনগাছা ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ডের পাঁচঠাকুরী গ্রামের ইউপি সদস্য জহরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে বন্যাকবলিতদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুত তাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে পারব।’ এই কয় দিন তাদের খোঁজ-খবর নেননি কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণ মেম্বর। চাইলেই আমরা সবকিছু করতে পারি না।‘
ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের শিমলা গ্রামের ইউপি সদস্য মো. তারেকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকায় বন্যার অবস্থা খুবই খারাপ। বানভাসিদের খোঁজ-খবর রাখছি। তবে সরকার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ আসেনি। ইউএনও স্যার বানভাসিদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। সেই অনুযায়ী তালিকা তৈরি করছি। বরাদ্দ এলে বানভাসিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’
ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের পাঁচটি ওয়ার্ডে বন্যার পানি ঢুকেছে। যাদের বাড়িতে পানি উঠেছে তারা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। সবার খোঁজ-খবর রাখা তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে ইউএনও’র নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে বানভাসিদের তালিকা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত পরিষদে কোনো বরাদ্দ আসেনি। এলে সেগুলো বিতরণ করা হবে।’
সিরাজগঞ্জ সদরের কালিয়হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সবুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের মধ্যে রামগাঁতী গ্রামে বন্যার পানি ঢুকেছে। যাদের বাড়িতে পানি উঠেছে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ইউএনও’র নির্দেশে তাদের তালিকা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।’
বানভাসিদের জন্য সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাশুকাতে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বানভাসিদের তালিকা তৈরির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা তালিকাও তৈরি করছেন। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ত্রাণের বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছি। বরাদ্দ এলে বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হবে।’
সারাবাংলা/পিটিএম