ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী, ব্যয় বাড়ছে বঙ্গবন্ধু টানেলের
১৭ জুলাই ২০২২ ২২:২৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নির্মাণের শেষের পথে এসে বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় এবং নতুন কিছু অবকাঠামো যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় কমপক্ষে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে।
প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত প্রস্তাব পাঠানো হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক)। এরপর জানা যাবে চূড়ান্তভাবে ব্যয় কত বাড়ছে।
কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে টানেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ কাজ করছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’ (সিসিসি)। চলতি জুলাই পর্যন্ত সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ।
আরও পড়ুন- বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ শেষের পথে, নিরাপত্তা পরিকল্পনা কতদূর?
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য বলছে, ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুইটি করে মোট চারটি লেন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।
নগরীর পতেঙ্গায় ন্যাভাল একাডেমির পাশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে স্থলপথে বের হবে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দু’টি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।
নদীর তলদেশের টানেলের দু’টি টিউবের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। টানেলের ভেতরে অবকাঠামোগত কাজ চলছে। মূল টানেল ও সংযুক্ত সড়ক তৈরিসহ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। ডিসেম্বরের মধ্যে টানেলের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সেতু বিভাগ।
আরও পড়ুন- সুড়ঙ্গের খনন শেষ, বঙ্গবন্ধু টানেলের দু’পাড়ে ‘আশার আলো’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হার সুদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। বাংলাদেশ সরকার জোগান দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। কিন্তু সেই প্রস্তাবিত ব্যয় এক বছরের মাথায় এক দফা পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী সারাবাংলাকে জানান, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) টানেলের জন্য বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র এক কোটি টাকা। কাজ শুরুর পর নির্মাণকারী সংস্থা সিসিসি জানায়, টানেলের জন্য অন্তত ১৫ মেগাওয়াটের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন। তখন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দ্বারস্থ হন প্রকল্প পরিচালক। পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হলে টানেলের দুই প্রান্তে দু’টি সাবস্টেশন তৈরি করতে হবে। এতে ব্যয় ধরা হয় ৮২ কোটি টাকা।
সেই ৮২ কোটি টাকার সংস্থান করতে গিয়ে এক বছরের মধ্যে ডিপিপি পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়। তবে প্রকল্প ব্যয়ে কাটছাঁট করে সেই ব্যয়ে সংস্থান করায় মোট ব্যয় বাড়েনি। কিন্তু সেতু বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ্য সচিবের উদ্যোগে অগ্রিম টাকা ছাড়াই পিডিবি সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু করে। ডিপিপি সংশোধনের পর সেই টাকা পিডিবিকে পরিশোধ করা হয়।
দ্বিতীয় দফায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডিপিপি আবারও সংশোধন করতে হচ্ছে, যেটাকে কার্যত বড় ধরনের সংশোধন হিসেবেই বিবেচনা করছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি।
প্রকল্প পরিচালকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে যে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছিল তাতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরা হয়েছিল ৮০ টাকা। কাজ চলার মধ্যেই ডলারের দর বেড়ে বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ৮৩ দশমিক ৭ টাকায়। সবশেষ ব্যয় বাড়ানোর যে খসড়া প্রস্তাব প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে সেতু বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে, তাতে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরা হয়েছে ৯২ দশমিক ৫০ টাকা।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গত ১৪ জুলাই মার্কিন ডলারের বিপরীতে চলতি বছরে টাকার ১৯তম অবমূল্যায়ন হয়। ফলে প্রতি ডলার কিনতে এখন গুণতে হচ্ছে ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। প্রতি ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় মূল্য ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা, আগে যা ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা।
আরও পড়ুন- বঙ্গবন্ধু টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘ডলারের রেট আমরা প্রস্তাব করেছি ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ এখনই রেট বেড়ে ৯৩ টাকা পার হয়ে গেছে। আমাদের প্রস্তাব সেতু বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাইয়ের পর যখন একনেকে উঠবে, তখন (ডলারের বিনিময় হার) আরও বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে প্রকল্পের ব্যয় টাকায় বাড়ছে। সিসিসির সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি, সেটা কিন্তু ডলারে। সেটা কিন্তু বাড়ছে না, ডলার ঠিকই থাকবে। শুধুমাত্র এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে আমাদের ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়তে পারে।’
‘সিসিসির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে ডলারে। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি করা হয়েছে, তার একটা হয়েছে ডলারে, আরেকটা হয়েছে আরএমবিতে (চীনা মুদ্রা)। ৪০৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে, আর ৩০০ মিলিয়ন ডলার আরএমবিতে। ৩০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি যখন হয়, তখন ১ ডলার সমান ছিল ৬ দশমিক ৫ আরএমবি, অর্থাৎ ১৯৫০ মিলিয়ন আরএমবি। এটা কিন্তু উত্তোলন হয়ে গেছে। কিন্তু ডলারেরটা আমরা উত্তোলন করতে পারিনি রেটের কারণে।’
আরও পড়ুন- কর্ণফুলীর তলদেশ ছুঁয়েছে দেশের প্রথম টানেল
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টানেলের অবকাঠামো খাতে নতুনভাবে স্ক্যানার স্থাপনের একটি অঙ্গ যুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলেও ডিপিপি সংশোধন করে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে।
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘স্ক্যানার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। কিন্তু আমাদের মূল যে ডিপিপি, সেখানে স্ক্যানারের বিষয়টি ছিল না। এখন আমরা সেটিকে যখন যুক্ত করছি, তখন ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকার মতো বাড়তি খরচ আসতে পারে। এ হিসাবে আমরা বলতে পারি, ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা এবং স্ক্যানার স্থাপনের জন্য ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা, সব মিলিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় বাড়তে পারে।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
কর্ণফুলী নদী টানেল নির্মাণ বঙ্গবন্ধু টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান