প্রতি ইউনিটে ভর্তুকি ঠেকেছে ৩৫ টাকায়, বাধ্য হয়ে লোডশেডিং!
১৮ জুলাই ২০২২ ২২:৫৬
ঢাকা: বাংলাদেশের ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। যার মধ্যে ১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট উৎপাদন হয় ডিজেল ব্যবহার করে। যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ছয় শতাংশ। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ৩৫ টাকা। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে এখন তা ৪০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এর বিপরীতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি হচ্ছে মাত্র পাঁচ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার ভুর্তুকি দিচ্ছে ৩৫ টাকা। অন্যদিকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিট ৩৯ টাকা। আর বিক্রি হয় ৮ টাকা। এখানেও প্রতি ইউনিটে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ইউনিট ৩২ টাকা। তাই বাধ্য হয়েই সরকারকে লোডশেডিংয়ে যেতে হচ্ছে।
এদিকে, চলতি বছরই দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিয়েছে সরকার। ফলে বেড়েছে চাহিদা। কিন্তু চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দামও বেড়েছে। এছাড়া বর্তমানে বেড়েছে ডলারের দাম, কমেছে টাকার মান। সরকার মনে করছে, এই পরিস্থিতিতে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই অর্নিদিষ্টকালের জন্য দেশের সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসস্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এ পরিস্থিতি সাময়িক। বিপদ কেটে গেলে আমরা আগের অবস্থানে ফিরে যাব।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫২টি। এর মধ্যে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১০টি। এই ১০ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়। যা মোট উৎপাদনের ছয় শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ৬০ কোটি ৭২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ৩ হাজার ২২৯ কোটি ৭ লাখ টাকা। বিতরণ সংস্থাগুলো বলছে, গেল অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হতো তার থেকে প্রতি ইউনিটে প্রতি কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। আর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন খরচ তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্যমতে, দেশে এই সময়ে ডিজেলের চাহিদা ৪৬ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ১৪১ ডলার। বর্তমান মার্কিন ডলারের মূল্য অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় যার দাম দাড়ায় ১২ হাজার ৬৯০ টাকা। এক ব্যারেল সমান ১৫৯ লিটার। তাতে এক লিটারের দাম দাঁড়ায় ৮০ টাকার মতো। ফলে যে ১০টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে তাতে দৈনিক চাহিদা পৌনে তিন লাখ মেট্রিক টন।
বিপিসি বলছে, প্রতি ব্যারেল ৯০ ডলারের ওপরে গেলে লোকসান গুনতে হয়। জানুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। যা কোনোভাবেই সামাল দিতে পারছিল না প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে গড়ে দৈনিক ১১০ কোটি টাকা জ্বালানি সরবরাহে লোকসান গুনছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। এই লোকসান ঠেকাতেই তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার।
এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘আন্তজার্তিক বাজারে দাম যখন দাম কম ছিল তখনও সরকার ভর্তুকি দিত। এখন সেই দাম বেড়ে চার থেকে পাঁচগুণে গিয়ে ঠেকেছে। এই পরিমাণ ব্যয় বহন করা সরকারের পক্ষে অস্বাভাবিক। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে ইউরোপ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অনেক দেশ রেশনিং শুরু করেছে। কিছু কিছু দেশ দাম সমন্বয় করেছে। এমন পরিস্থি দেখা গেছে এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশ। আমরা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণকে চাপে ফেলতে চাইনি।’ যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা ইতিবাচকভাবে নিতে সকলের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় গ্যাস। মোট বিদ্যুতের ৬৫ ভাগ গ্যাসে উৎপাদন হয়। ৬৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাস। ৬৪টি কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল। আর ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া রয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাইড্রো বা জলবিদ্যুৎকেন্দ্র, সোলার পার্ক। আর এসবের সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি করা হয় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
সরকারের সূত্রগুলো বলছে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে কম খরচ হয়। বর্তমানে গড়ে প্রতি ইউনিট হাইড্রো বা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় মাত্র ১৫ পয়সা। ডিজেলে উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ৪০ টাকা, এলএনজিতে ব্যয় ৩৯ টাকা, সোলারে ব্যয় ১২ টাকা, ফার্নেস অয়েলে ব্যয় ১২ টাকা। গত কয়েক বছর ধরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধে বিশ্বজুড়ে উদ্যোগ চলমান। সে উদ্যোগে সরকারও ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার পরিকল্পনা করছে, তেলভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র কমিয়ে আনার।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘এখনি সে রকম চিন্তা করা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে দেখা যাক। তবে আপাতত বন্ধই রাখতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকব।’
উল্লেখ্য, চলতি বছরেই দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছিলো সরকার। আর এ উদ্যোগের জন্য দেশের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদকেও ভুষিত হয় বিদ্যুৎ বিভাগ।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম
৩৫ টাকা গ্যাস ডিজেল প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎকেন্দ্র ভর্তুকি লোডশেডিং