‘প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অনেক ভালোবাসি’
২১ জুলাই ২০২২ ১৬:২৬
রামগতি (লক্ষ্মীপুর) থেকে: ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের উপকারভোগীরা জমিসহ মাথা গোঁজার ঠিকানা পেয়ে আনন্দে ভাসলেন। অসহায় নিঃস্ব পরিবারের উপকারভোগীরা কৃতজ্ঞতা স্মরণ করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। তিনিও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে জাতির পিতার দেখানো আদর্শিক পথে দেশের জনগণের সেবায় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
তাই উপকারভোগী পরিবারের এক শিক্ষার্থী আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন আপনি ঘর দিয়েছেন। নিজস্ব ঠিকানায় চিঠি পাবো। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অনেক ভালবাসি। আপনার ছবি ঘরে টাঙিয়ে রেখেছি। প্রতিদিন পরিষ্কার করি। ঘর পেয়ে অনেক খুশি। বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। আপনার ঘর দেওয়ার কারণেই এটি হয়ত এখন পারব।’
বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) সকালে ভূমিহীন ও গৃহহীন ২৬ হাজার ২২৯টি পরিবারকে জমিসহ গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপকারভোগীরা এমন অনুভূতি ব্যক্ত করে এ সব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পাঁচটি গৃহ নির্মাণস্থলপ্রান্তে যুক্ত ছিলেন। স্থানগুলো হলো রামগতি, লক্ষ্মীপুর; রামপাল, বাগেরহাট; নান্দাইল, ময়মনসিংহ; পঞ্চগড় সদর; পঞ্চগড় এবং মোহাম্মদপুর, মাগুরা। উদ্বোধন ঘোষণা করে এসব প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জমির দলিল, ঘরের চাবিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসটাপত্র বুঝে দেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় নেতারা।
প্রসঙ্গত মুজিববর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আরও ২৬ হাজার ২২৯টি পরিবার নতুন স্থায়ী ঠিকানা পেল। বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাঁচটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে যুক্ত হয়ে এই ঘরগুলো হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাড়িগুলো হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলাসহ দেশের মোট ৫২টি উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। উপজেলাগুলো হলো- ঢাকার নবাবগঞ্জ, মাদারীপুরের মাদারীপুর সদর, শরীয়তপুরের ডামুড্যা কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, টাঙ্গাইলের গোপালপুর, মানিকগঞ্জের ঘিওর, সাটুরিয়া, রাজবাড়ীর কালুখালী। ফরিদপুরের নগরকান্দা, নেত্রকোণার মদন, ময়মনসিংহের ভালুকা, নান্দাইল, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, জামালপুর বক্সীগঞ্জ। চট্টগ্রামের পটিয়া, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগঞ্জ, ফেনীর ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পঞ্চগড় সদর, দেবীগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, বোদা। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও’র বালিয়াডাঙ্গী। নীলফামারীর ডিমলা, নওগাঁ’র রাণীনগর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, রাজশাহীর মোহনপুর, চারঘাট, বাঘা, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া নাটোরের বাগাতিপাড়া। পাবনা ঈশ্বরদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ, ঝিনাইদহ হরিণাকুণ্ডু, সাতক্ষীরার তালা, মাগুরার মাগুরা সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর, শালিখা, ঝালকাঠির কাঠালিয়া, পটুয়াখালী দশমিনা।
গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কাযালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস।
উদ্বোধনী বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি স্থানে উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। প্রথমে মতবিনিময় করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে রামগতি থেকে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেছিলেন, সেই রামগতির চড় পোড়াগাছা ইউনিয়নের চরকোলাকোপা আশ্রয়ণ কেন্দ্র থেকে। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোছাইন আকন্দের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে আশ্রয়ণের জায়গা পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ্দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি চারণ করেন। এরপর অনুভূতি ব্যক্ত করেন উপকারভোগী নাসিমা আকতার।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমানের পরিচালনায় জলদস্যু জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা উপকারভোগী আবদুল হান্নান, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক এনামুল হকের পরিচালনায় অনুভূতি ব্যক্ত করেন উপকারভোগী নাসিমা খাতুন ও জমিলা খাতুন, মাগুড়া জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলমের পরিচালনায় জাঙ্গালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে শাহীনুর বেগম, শিক্ষাথী প্রিয়াংকা সরকার, পঞ্চগড় সদরের মাহানা পাড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষাথী জান্নাত, রিক্সা চালক রবিউল।
লক্ষ্মীপুরের রামগতির চর পোড়াগাছায় বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে আশ্রয়ণের জায়গা পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ্দিন জাতির পিতার স্মৃতি চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। আমরা স্বাধীন দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন ছিলাম। জাতির পিতা ৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চর পোড়াগাছা গ্রামে পরিদর্শন করেন। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি নিজ হাতে মাটি কেটে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গা দেন। সেখানে জাতির পিতাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। জাতির পিতার দয়ায় আমরা আড়াই একর জায়গা পাই। সেখানেই খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। আমরা অনেক অনেক সুখে আছি।’
নাসিমা আক্তার বলেন, ‘ভূমিহীন আমাকে জায়গা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। প্রধানমন্ত্রী আপনি জায়গা দিয়েছেন। আমাদের মুখে এখন হাসি। আপনাকেও আমরা হাসি মুখে দেখতে চাই। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেচে থাকুন। আপনার হাসিমুখ দেখতে চাই।’
বাগেরহাটের আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের পরিবারে ৯ সদস্যের সংসার। পিতার পক্ষে চালানো বড়ই কঠিন ছিল। সংসারের কথা বিবেচনা করে জলদস্যুতার জীবন বেছে নেই। খেয়ে না খেয়ে সুন্দরবনে দুঃসহ জীবন কাটিয়েছি। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে সুন্দর জীবন দিয়েছেন। আপনার দেওয়া সাধারণ ক্ষমায় আমি সুন্দর জীবন পেয়েছি। এখন ঘর দিলেন। কখনো ভাবিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, গ্রামে আসতে পারব, নিজের বাড়িতে থাকতে পারব। সেই সুযোগ হয়েছে। এখন আমি দিনমজুরের কাজ করি। আগামীতে ব্যবসা করতে চাই।’
ময়মনসিংহের নাসিমা খাতুন বলেন, ‘চার সন্তান রেখে স্বামী চলে যায়। এক সন্তানকে দত্তক দেই। অন্যের জমিতে থেকে সন্তানদের পড়ালেখা করিয়েছি। ঘর ছিল না। আপনি ঘর দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাদের কাছে আসবেন, ডাল ভাত খেয়ে যাবেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, আসার চেষ্টা করব।’
জমিলা খাতুন বলেন, ‘স্বামী আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। আপনি ঘর দেওয়ার পর স্বামী আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমি এখন অনেক সুখি।’
বাগেরহাটের শাহীনুর বলেন, ‘আগে ঘর ছিল না। এখন ঘর পেয়ে অনেক খুশি। পদ্মাসেতুর কারণে অনেক খুশি হয়েছি। কারণ আমার মায়ের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। ২০২০ সালে মা যখন মারা যান, তখন মায়ের মুখ দেখতি পারিনি, কারণ ফেরি ৩ ঘণ্টা দেরি করেছিল। এখন বাপের বাড়ি যেতে আর তিনঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না।’
শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা সরকার বলেন, ‘বাবা একজন ভ্যান চালক। কোন ঠিকানা ছিল না। এখন ঠিকানা পেয়েছি। আগে মনে মনে বলতাম, আমাদের কী নিজস্ব ঠিকানা হবে না? নিজস্ব ঠিকানার অভাবে চিঠি পাবো না? এখন আপনি ঘর দিয়েছেন। নিজস্ব ঠিকানায় চিঠি পাবো।’
পঞ্চগড়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষাথী জান্নাত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অনেক ভালবাসি। আপনার ছবি ঘরে টাঙিয়ে রেখেছি। প্রতিদিন পরিষ্কার করি। ঘর পেয়ে অনেক খুশি। বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। আপনার ঘর দেওয়ার কারণেই এটি পারব।’
রিকশাচালক রবিউল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ঢাকায় রিকশা চালাতাম। বড় বড় দালান দেখে মনে মনে ভাবতাম, আমার কি একটা টিনের ঘরও হবে না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি সে ব্যবস্থা করেছেন। এক মা আমাকে জন্ম দিয়েছে, আরেক মা আপনি ঘর দিলেন। এ সময় রবিউল অনুষ্ঠানস্থলে মাটিতে পা রেখে প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করেন।’
সারাবাংলা/এনআর/একে