আওয়ামী লীগের সম্মেলন: আলো আসুক কেন্দ্র থেকে প্রান্তে
৩১ জুলাই ২০২২ ১৩:৫১
টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের সময়কালে দেশে উন্নয়নে ‘স্বস্তি’ থাকলেও ক্ষমতাসীন দলটির সামনে এরইমধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জটি দলটির জন্য বড় গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যে যে উপদল-বিদ্রোহী গ্রুপ দৃশ্যমান সেগুলো কমিয়ে দলের নেতাকর্মীকে এক কাতারে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আওয়ামী লীগকে সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতিতে ফের ক্ষমতায় আসতে হবে।
গত ২৯ জুলাই ঢাকা মহাগর উত্তর আওয়ামী লীগের এক সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিয়েছেন: সময় বেশি নেই, এখনই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে বন্ধন জোরালো করে আওয়ামী লীগকে ফের বিজয়ী করতে হবে।
আওয়ামী লীগ এরইমধ্যে হয়ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘরোয়া প্রস্তুতি শুরু করেছে। এদিকে দুই মেয়াদে দায়িত্বে থাকা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে; ফলে ডিসেম্বরে জাতীয় কাউন্সিলের বিষয়টি এখন অনিবার্য বিষয়।
দলীয় দায়িত্বের পাশাপাশি সড়ক ও যোগাযোগখাতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামাল দিতে শারীরিকভাবে দুর্বল ওবায়দুল কাদেরের বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। শারীরিক ‘ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন’ থেকে উতরে এসে আগের মতো তেজস্বী ভূমিকা ম্রিয়মাণ তার বেলায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বড় আয়োজনের ঝক্কি মোকাবিলা করার মতো দৃঢ়তা ওবায়দুল কাদেরের নেই- তা এখন দলীয় ঘরানায় বেশ স্বীকৃত বিষয়। এমন অবস্থায় ওবায়দুল কাদেরের ‘অখণ্ড অবসরে’ যাওয়ার সময় হাতছানি দিচ্ছে।
নতুন একজন সাধারণ সম্পাদক মনোনয়নের বিষয়টি এমন ‘কঠিন সময়ে’ আওয়ামী লীগের জন্য বড় অগ্নিপরীক্ষা বটে! যিনি হবেন দলের কাছে সর্বগ্রহণযোগ্য, সর্বোপরী নিষ্কলুষ একজন নেতৃত্ব। যিনি আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনি তরীটি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিতে সক্ষম হবেন।
এরইমধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে বেশ কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে যারা রাজধানীকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বেশ ‘পটিয়সী।’ তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফরউল্লাহ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রাজ্জাক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, ড. হাছান মাহমুদ, দীপু মনি, মাহবুবুল আলম হানিফ প্রমুখের নাম।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলের মাঠপর্যায়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রকট। ২০২৩ সালের শেষে কিংবা ২০২৪–এর শুরুতে জাতীয় নির্বাচন। সম্মেলন হলে নতুন কমিটি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ। ফলে আগামী নির্বাচনটা কেমন হবে? দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কাকে বসানো হবে? এ সব এখন ভাবনার বিষয়।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও ঘনিষ্ঠ পরিসরে আলোচনা করছেন। সভাপতি পদে শেখ হাসিনাই থাকছেন, এটি নিশ্চিত। এর বাইরে এবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ দলের নেতৃত্বে আসতে পারেন—এমন আলোচনায়ও জোর পেয়েছে। অবশ্য আগের সম্মেলনগুলোতেও এই আলোচনা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আসেননি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতি ঘটনাবহুল হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। আগামী ডিসেম্বরে কেন্দ্রের সম্মেলন উপলক্ষে দেশব্যাপী তৃণমূলের সম্মেলন গুছিয়ে আনছে দলটি। এরইমধ্যে বেশকিছু জেলার সম্মেলন শেষ হয়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। ইউনিয়ন, পৌরসভা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সম্মেলন হচ্ছে। সম্মেলন ঘিরে যেমন দেশব্যাপী বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে, তেমনি ভেতরে ভেতরে বাড়ছে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা। কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক– এ প্রশ্নের উত্তর পেতে চায়ের টেবিলে আলোচনা উঠতে শুরু করেছে।
এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য সবচেয়ে আলোচিত নাম দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। দল ও সরকারকে আলাদা করার যে কৌশল, তাতে তিনি এগিয়ে আছেন। গত নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন না পেলেও তাকেসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে দলের নির্বাচন পরিচালনা করা হয়। পরে ছাত্রলীগ দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। নানক তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন, ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন, যুবলীগেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংগঠক হিসেবে দলে তার পরিচিতি আছে বলে সাধারণ সম্পাদকের দৌড়ে অনেকে তাকেই এগিয়ে রাখছেন।
ড. আব্দুর রাজ্জাককেও ওই পদের সম্ভাব্য হিসেবে গণ্য করছেন অনেকে। তিনি দলের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এবং সরকারে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। গত দুই সম্মেলনে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র এবং গত নির্বাচনে ইশতেহার প্রণয়নের কাজ করে তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। গত সম্মেলনেও সাধারণ সম্পাদক পদের দাবিদার ছিলেন তিনি। কিন্তু দলের তৃণমূলের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুব একটা নেই বলে সমালোচনা করা হয় তার। তবে দলের অভ্যন্তরীণ, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক পদে মাহবুবউল আলম হানিফের নাম খুব জোরেশোরেই আলোচনায় আছে। দীর্ঘদিন তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক পরিপক্বতা দেখিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখেন। গত কয়েক বছরে তিনি অনেক ইস্যুতে তার সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। জাতীয়ভাবেও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তার। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় তিনি। এটি যেমন তার জন্য ইতিবাচক, আবার সাধারণ সম্পাদক প্রার্থিতায় নেতিবাচক।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ড. হাছান মাহ্মুদের সম্ভাবনাও কম নয়। তিনি দলের অন্যতম মুখপাত্র। দলে তার উত্থান হয়েছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং সাংগঠনিক বিষয়ে তিনি এখন ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। তথ্য মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন। সমানতালে সময় দিচ্ছেন দলেও। এসব কারণে তার সম্ভাবনাকে অনেকেই এগিয়ে রাখতে চান।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তেমন প্রভাবশালী না হলেও শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তবে সম্প্রীতি চাঁদপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় জমি কেলেঙ্কারিতে তার স্বজনদের নাম আসায় দীপু মনি এসেছেন বিতর্কে।
যুগ্ম সম্পাদক পদে অপেক্ষাকৃত তরুণ বাহাউদ্দিন নাছিম কর্মীদের অত্যন্ত পছন্দের একটি নাম। কর্মীবান্ধব হিসেবে তার পরিচিতি আছে।
এতকিছুর পরও আমাদের চাওয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একজন সৎ, স্বচ্ছ ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা আসুক। যিনি কথিত সিন্ডিকেট চর্চার বাইরের মানুষ; এরকম কেউ আসুক। তাহলেই মনে করি আওয়ামী লীগ তার চলমান সোনার তরীটি নিতে পারবে আসল গন্তব্যে।
উপরের তালিকার বাইরে আরেকজনের নাম আলোচনায় আনতে চাই। তিনি হলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম এ এইম এম কামরুজ্জামানের ছেলে খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য বটে। কোথাও ‘গুরুগম্ভীর’ কোথাও ‘প্রাণখোলা’ নেতৃত্ব বলতে যা বুঝি তার পুরোটাই খায়রুজ্জামান লিটনের মধ্যে নিহিত। তিনি পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত, আওয়ামী লীগের চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কখনও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে বিতর্কিত করেননি। আওয়ামী লীগের রক্তের রক্তে বেঈমানি করার দীক্ষা তিনি কখনও নেননি। রাজধানীর বাইরে নিজস্ব এক গণ্ডিতে তিনি নিভৃতে-নীরবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জাতীয় চার নেতার আদর্শ, ছড়িয়ে দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তার মশাল। আমার মনে হয় কেন্দ্রের চোখ কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে গেলে খায়রুজ্জামান লিটন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মানানসই।
আগে জাতীয় চার নেতার সন্তানদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিম সক্রিয় ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু এদের দুইজনের মৃত্যুর পর এখন রাজনীতিতে সক্রিয় এবং নেতৃস্থানীয় থাকা নেতা হলেন খায়রুজ্জামান লিটন। এইজন্য জাতীয় চার নেতার সন্তান হিসেবে আওয়ামী লীগে তার একটা আলাদা অবস্থান আছে।
খায়রুজ্জামান লিটন অন্তপ্রাণ একজন রাজনীতিবিদ। তিনি কখনওই শেখ হাসিনার আনুগত্যের বাইরে যাননি। এটি তার একটি বড় যোগ্যতা। তবুও রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। কে হবেন আওয়ামী লীগ সভাপতির কো-পাইলট তা হয়ত তিনিই নির্ধারণ করবেন ভেবেচিন্তে। তবে আমাদের চাওয়া কেন্দ্রে থেকে আলো পড়ুক প্রান্তের দিকে। এরইমধ্যে হয়ত খুঁজে নেওয়া যাবে আওয়ামী লীগের যোগ্য একজন সাধারণ সম্পাদক, একজন দুর্গম গিরির কাণ্ডারী।
লেখক: সাংবাদিক
আওয়ামী লীগ খায়রুজ্জামান লিটন জাতীয় সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ সম্পাদক