নদী ভাঙনে দিশেহারা তিস্তাপাড়ের মানুষ
৬ আগস্ট ২০২২ ২০:০৬
লালমনিরহাট: তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায় পাড় ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। তিস্তার তীরবর্তী বাসিন্দাদের চোখের সামনেই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও ফসলি জমি। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে দিশেহারা এসব মানুষ।
ভারত অংশে নির্মিত গজলডোবায় বাঁধের মাধ্যমে দেশটির সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় শীতের আগেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশ অংশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিস্তার বাম তীরের জেলা লালমনিরহাট।
এবারে বর্ষার ভয়াবহ বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভাঙন আতঙ্কে পড়ে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। গত সপ্তাহে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই তীব্র ভাঙনের মুখে পড়ে নদীপাড়ের মানুষ। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ৮ থেকে ১০ বার সরিয়ে নিয়েছেন বসতভিটা। কেউ কেউ রাস্তার ধারে বা বাঁধের পাশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের খামারটারী ও পূর্ব কালমাটি গ্রামের প্রায় ১০ থেকে ১৫টি বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে চোংগাডারা উচ্চ বিদ্যালয়, খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদ, ভূমি অফিস, খুনিয়াগাছ উচ্চ বিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। নদীর কিনারায় পড়েছে নির্মাণাধীন চোংগাডারা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা বিশিষ্ট ভবনসহ তিনশতাধিক বসতবাড়ি।
গত সপ্তাহে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন পরিদর্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কিছু জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে কিছুটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তা না করলে এসব স্থাপনা বিলীন হয়ে যেত বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।
সদর উপজেলার পূর্ব কালমাটি গ্রামের মৃত খোরশেদের স্ত্রী মিনু বেওয়া তিনবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এখন অন্যের জমি ৩০ হাজার টাকায় বন্ধক নিয়ে তিনটি ঘর করে দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন। সেই বসতভিটাও নদীর মুখে পড়েছে। ওই জমি নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় বন্ধকের ৩০ হাজার টাকাও দিচ্ছেন না জমির মালিক। টাকার অভাবে মাথা গোজার ঠাঁই করতে পারছেন না মিন। স্থানীয়দের সহায়তায় ও নিকট আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে গতকাল শুক্রবার (৫ আগস্ট) ঘর তিনটি সরিয়ে পাশের একজনের জমিতে রেখেছেন। নতুনভাবে বাড়ি করার কোনো উপায় না পেয়ে দিশেহারা তিনি।
এ বিষয়ে মিনু বেওয়া বলেন, ‘চারবার ঘর-বাড়ি সরাতে গিয়ে সম্বল শেষ করেছি। এখন ঘর খুলে অন্যের জমিতে রেখেছি। রাতে কোথায় থাকব জানি না। এক সময় নিজের অনেক জমি ছিল। এখন দাঁড়িয়ে থাকার মতো কোনো জমি নেই। টাকা ছাড়া মিলে না জমি। সেই টাকাও নেই।’
পাশের গ্রাম খামারটারীর আছিবি, সোনাবি, আকলিমা জানান, কখন ঘর-বাড়ি নদীতে ভেঙে যায়, এই ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেন না তারা। কয়েকদিন আগে উপজেলা চেয়ারম্যান কিছু জিও ব্যাগ দিয়ে কোনো রকম ভাঙন ঠেকাতে পেরেছেন। নয়তো এতদিনে এ গ্রামও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেত। রিলিফ নয়, দ্রুত নদী খনন করে স্থায়ী সমাধান দাবি করেন তারা।
শুধু খামারটারী আর পূর্ব কালমাটি নয়। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে তিস্তা নদীর বামতীর ঘেঁষা প্রতিটি গ্রামের মানুষ। এসব মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি তিস্তা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের। যাতে অনাবাদি থাকা তিস্তার বুকের হাজার হাজার বিঘা জমি চাষাবাদের আওতায় আসে। এসব জমি চাষাবাদ করে সংসার চালাবেন তারা।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘৫টি উপজেলা নদীবেষ্টিত হলেও এবারে তিস্তার ভাঙনটা সদর উপজেলায় কিছুটা বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলমান রয়েছে। কিছু কিছু স্থানে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বাকিগুলোও কয়েকদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে।’
সারাবাংলা/এনএস