ফের প্রস্তুত হচ্ছে ডেমু ট্রেন, শিগগিরই যুক্ত হবে রেলওয়ে বহরে
১৩ আগস্ট ২০২২ ০৮:৩৮
ঢাকা: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো যাতায়াত ব্যবস্থা আরও সহজ ও দ্রুত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত করা হয়েছিল আধুনিক প্রযুক্তির ডেমু ট্রেন। কিন্তু নিয়মিত মেইন্টেনেন্সের অভাবে কিছু দিনের মধ্যেই বিকল হতে শুরু করে পৌনে সাত কোটি টাকা দিয়ে কেনা ডেমু ট্রেন। দীর্ঘদিন বিকল হয়ে থাকা সেই ডেমু ট্রেন সচল করে তুলেছেন দেশের একদল প্রকৌশলী।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রেনগুলোর আয়ুষ্কাল ২০ বছর ধরা থাকলেও চার বছরের মধ্যেই ২০ সেট ডেমু ট্রেনের অধিকাংশ চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। চীনের উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি হঁটিয়ে দেশীয় প্রযুক্তি আর যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে ইতোমধ্যে কয়েক সেট ডেমু ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলেছেন দেশের প্রকৌশলীরা। যার মধ্যে এক সেট ট্রেন শিগগিরই যাত্রী পরিবহনের জন্য ফের বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত করা হবে। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে ট্রায়াল রানও শেষ হয়েছে।
যেভাবে কেনা হয়েছিল ডেমু ট্রেন:
ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু— এর বৈশিষ্ট হচ্ছে ট্রেনের দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন থাকে আর মাঝখানে থাকে বগি। একেকবার ১৪৯ জন যাত্রী আসনে বসে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। আর এছাড়া দাঁড়িয়ে থেকেও এক থেকে দেড়শ যাত্রী নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারেন।
রেলওয়ে সূত্র অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী এলাকায় অফিসগামী বা কম দূরত্বে যাতায়াতাকারী যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের জন্য এই ধরনের ট্রেন কিনতে ২০১১ সালে চীনের ট্রেন সরবরাহকারী একটি কোম্পানির সঙ্গে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চুক্তি করে সরকার। চীনের সিএনআর টানসান রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড মোট ২০ সেট ডেমু বাংলাদেশে সরবরাহ করে। মূল চুক্তি ৪২৬ কোটি টাকা থাকলেও শুল্ক ও কর যুক্ত হয়। সব মিলিয়ে ওই ২০ সেট ডেমু কিনতে সরকারের খরচ হয় ৬৭৫ কোটি টাকা। চুক্তির দুই বছর পর ২০১৩ সালে ডেমু ট্রেনগুলো বাংলাদেশ বুঝে পায়। ওই বছরের এপ্রিল মাসে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলের মধ্য দিয়ে ডেমুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ডেমু চলাচলের রুট:
সূত্র অনুযায়ী, ঢাকা-টঙ্গী (২২ কিলোমিটার), ঢাকা-জয়দেবপুর (৩৪ কিলোমিটার), জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ (৯০ কিলোমিটার, সিলেট-আখাউড়া (১৭৬ কিলোমিটার), ঢাকা আখাউড়া-ঢাকা (১২০ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-কুমিল্লা (১৫৫ কিলোমিটার), নোয়াখালি-লাকসাম ( ৪৮ কিলোমিটার), লাকসাম-চাঁদপুর (৪৯ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-নাজিরহার (৩৭ কিলোমিটার), পাবর্তীপুর-লালমনিরহাট ( ৭১ কিলোমিটার) এবং পাবর্তীপুর-পঞ্চগড় (১৩২ কিলোমিটার রুটে ওই ২০ সেট ডেমু চলাচল শুরু করে। মোট ২০ সেট ডেমুর এক সেট বরাদ্দ দেওয়া হয় পশ্চিমাঞ্চলের জন্য।
মেয়াদের আগে বিকল হলো ডেমু:
ডেমুর বৈশিষ্ট অনুযায়ী এই ট্রেন চলাচল করবে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পথের মধ্যে। কিন্তু সে নির্দেশনা মেনে চলেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে। ডেমু কেনা হলেও তা মেরামতের জন্য কোনো ওয়ার্কশপ করা হয়নি। দূরত্ব সীমার চেয়ে বেশি চালানো, মেরামত কারখানা না থাকা, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ডেমুর প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল হওয়া, সফটওয়্যার বেইজড এবং দেশের বাজারে ডেমুর যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততাসহ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আয়ুষ্কাল ২০ বছর ধরা হলেও চার বছরের মধ্যেই অকেজো হতে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী এলাকায় অফিসগামী যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের স্বপ্ন দেখানো ডেমু ট্রেন। বছর সাতকের মধ্যে ২০ সেট ডেমুর ১৩টিই নষ্ট হয়ে যায়। এরমধ্যে পূর্বাঞ্চলে চলাচল করা ১৮ সেট ট্রেনের ১২ সেটই বিকল। আর পশ্চিমাঞ্চলের জন্য যে এক সেট ডেমু চলাচল করত তা নস্ট হয়ে গেছে। ফলে পশ্চিমাঞ্চলে ডেমু চলাচল বন্ধ। বন্ধ রয়েছে পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ রুটে চলাচল করা ডেমু ট্রেন।
দীর্ঘদিন বিকল হয়ে পড়ে থাকা ট্রেনগুলো চলাচলের উপযোগী করে তুলতে চীনা প্রকৌশলীদের সহায়তা চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু তারা ক্রয়মূল্যের কাছাকাছি অর্থ দাবি করায় এগুলো মেরামতের আশা এক রকম ছেড়ে দিয়েছিল রেলওয়ে।
ডেমু সচলের গল্প:
দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা ডেমুগুলো শেষ বারের মতো মেরামতের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। এই কাজে যুক্ত করা হয় বাংলাদেশের কয়েকজন প্রকৌশলীকে। তারা টানা দেড় বছর অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কাঠখড় পুড়িয়ে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীনের সেই বিশেষ ট্রেনগুলো সচল করে তোলেন। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ডেমুর কাঠামো বজায় রেখে সবকিছু পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মডিউল পাল্টে সেখানে বসানো হয়েছে ইনভারটার। কোটি টাকার চাইনিজ ব্যাটারি বাদ দিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে দেশীয় ব্যাটারি আর তাতে দিব্যি চলছে ডেমু। প্রযুক্তির আগাগোড়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করা ডেমু ট্রেনগুলো সংস্কার করা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জের। তারা জানান, ডেমুর ইঞ্জিন ও কোচের ইলেক্ট্রনিক্স সিস্টেম অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। একেকটি সেটে ৪০টি সফটওয়্যার মডিউল করা হয়। সেগুলোর যন্ত্রাংশ এবং মেরামতের তরিকা কেবল চীনের ওই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছেই ছিল।
এ প্রসঙ্গে ডেমু সচল করার দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, যে সকল যানবাহনের যন্ত্রাংশ দেশে পাওয়া যায়না বা মেরামত মুশকিল সেগুলো নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের আগে থেকেই ছিল। সেই অভিজ্ঞতার জন্যই সাহস করে ডেমু মেরামতে হাত দেই।
তিনি বলেন, ডেমুর ইঞ্জিন ও কোচগুলোতে এমন জটিল কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে সফটওয়্যার ছাড়া কাজ হচ্ছিল না। পরে আমরা ওভারহলিং করে বডির বাইরের অংশে দেশের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে ইঞ্জিন ও কোচগুলো সচল করতে সক্ষম হই।
তিনি আরও বলেন, আমরা যে যন্ত্রাংশটি ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ থেকে পাচ্ছি তা চীন থেকে ক্রয় করতে গিয়ে দেখেছিলাম ৭ লাখ টাকা।
এই প্রকৌশলী বলেন, আমাদের এই কাজটা অনেক জটিল ও চ্যালেঞ্জের ছিল।
যাত্রী পরিবহনে প্রস্তুত ডেমু:
টানা দেড় বছর ধরে দেশের কয়েকজন প্রকৌশলী ডেমু মেরামতের জন্য কাজ করার মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৫ সেট ডেমু সচলের পথে। প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে একটি গাড়ির ট্রায়াল সফল হয়েছে।
পার্বতীপুর থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত একটানা চালিয়ে নেওয়া হয় সদ্য সচল হওয়া ডেমু। কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রীভর্তি ডেমুর ট্রায়াল রান হয়। অচল ডেমু সচল করার পেছনের যার সবচেয়ে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, সেই রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, এ কাজটি ছিল আমাদের জন্য অনেক দূরহ এবং চ্যালেঞ্জের। আমরা কখনো ভাবিনি ডেমু আবারও যাত্রী পরিবহনের উপযোগী করা যাবে।
তিনি বলেন, ট্রেন ব্যয়বহুল যানবাহন। এটির মেয়াদকালও অনেক বেশি। তার আগেই ইঞ্জিন বসে যাওয়া মানে রাষ্ট্রের অনেক বড় ক্ষতি। আমরা এগুলো মেরামতের চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যে ব্যয়ের হিসাব সামনে এসেছে তা ট্রেনগুলোর ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি। যা বহন করা আমাদের জন্য অসম্ভব ছিল। তারপর একরকম শূন্য থেকেই এই ডেমু মেরামতের উদ্যোগ নেই।
তিনি বলেন, ডেমুর চরিত্র কিছুটা আলাদা। এর জন্য দরকার আলাদা মেরামত কারখানা। যা ডেমুর ক্ষেত্রে করা হয়নি। যে কারণে ডেমুগুলো দ্রুত বসে গেছে। এর আগে আংশিক মেরামত করা ৬ সেট চালু আছে। ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমের জটিলতার কারণে বাকি ডেমুগুলো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। এই সিস্টেমটাই আমরা দেশি প্রযুক্তিতে মডিফাই করছি স্বল্প মূল্যের দেশি প্রযুক্তিতে।
তিনি আরও বলেন, কাজটি সহজ ছিল না। অনেক বাঁধা এসেছে। তারপরেও আমরা আজ সফল। আমরা সফল ট্রায়াল করেছি। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমে সব ডেমু সচল করার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের অনুমতি ও বাজেট পেলে এ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, ডেমু এখন যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রস্তুত। এ প্রসঙ্গে ডেমু সচল করার দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, আগামী সপ্তাহে আমরা একটি গাড়ি ছেড়ে দেবো যাত্রী পরিবহনের জন্য। তবে নতুনভাবে সংস্কার হয়ে আসা ডেমু আগের মতো যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। এটিতে সর্বোচ্চ এক হাজার যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারবে।
তিনি বলেন, আমরা সাতশ জনের বেশী যাত্রী নিয়ে পার্বতীপুর থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত সফল ট্রায়াল করেছি।
উল্লেখ্য, অত্যাধুনিক এই ডেমু ট্রেনের আলাদা কোনো ইঞ্জিনরুম না থাকলেও প্রতিটি কোচের আছে আলাদা চালিকাশক্তি। চীনের অত্যাধুনিক সেই জটিল প্রযুক্তি হঁটিয়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করলো বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা। দেখিয়ে দিলো বিশ্বসেরা প্রযুক্তি ছাড়াই ডেমু ট্রেন সচল করা সম্ভব।
সারাবাংলা/জেআর/এসএসএ