Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ই-সিগারেট বাড়াচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি, আইন সংশোধনের পরামর্শ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৯ আগস্ট ২০২২ ১৬:৩৭

ঢাকা: ‘ধূমপানে বিষপান’, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’— – এই কথাগুলো বেশ প্রচলিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করতে এমন প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধূমপানের প্রভাব নিয়ে যখন বিশেষজ্ঞরা এটিকে নিষিদ্ধের দাবি তুলছেন তখন দেশে বাড়ছে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিংয়ের ব্যবহার। সহজে বহনযোগ্য ও তুলনামূলকভাবে ক্ষতি কম বিবেচনায় নিয়ে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে তরুণদের মাঝে।

বিজ্ঞাপন

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধূমপানের সমপরিমাণ ক্ষতি আছে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং ব্যবহারেও। ই-সিগারেটে নিকোটিনের পরিমাণ বেশি থাকায় ধূমপানের চাইতেও বেশি ক্ষতি ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং ব্যবহারে। আরও কিছু উপাদান যুক্ত হওয়ার কারণে ই-সিগারেট মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়। বিশ্বের অনেক দেশে এমন ঘটনা আছে। আর তাই এই ধরনের সিগারেটের ব্যাপারে আইন করা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যেকোনো রাসায়নিক পদার্থের আসক্তি স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। উদ্ভাবনী কৌশল, নানা রকমের সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের প্রচারণার মাধ্যমে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে তামাক বিরোধী আইন সংশোধিত করা হলেও সেখানে ই-সিগারেট নিয়ে কোনো কিছুই বলা হয়নি। ফলে ভয়ঙ্কর এই সিগারেট বিক্রি ও সেবনকারীর সংখ্যা বেড়ে চলছে আশঙ্কাজনক হারে।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইতিমধ্যে অনেক দেশ ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশেও তাই খুব দ্রুতই এটি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলেও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

 

সিগারেট বা ভ্যাপিং কী?

ভ্যাপ বা ভ্যাপিং শব্দটির উৎপত্তি ভ্যাপোরাইজার থেকে। বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্রের সাহায্যে কোন সল্যুশন বা জ্যুসকে তাপের সাহায্য নিয়ে অ্যারোসলাইজ করার প্রক্রিয়াকে ভ্যাপিং বলা হয়। এই বিশেষ যন্ত্রটি হলো ই-সিগারেট যেখানে মূলত নিকোটিন বেসড সল্যুশন ব্যবহার করা হয়।

মূলত এই ভ্যাপিং ডিভাইসটিকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণে এতে ব্যবহৃত ভ্যাপ সল্যুশন আরও বেশি ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের কার্ডিওলজিস্ট তামান্না সিং জানান, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত উপাদানের সাথে কার্ডিওপালমোনারি টক্সিসিটি ও ক্যানসারের সংযোগ রয়েছে। এছাড়াও এই সল্যুশনে নিকোটিন উপস্থিত থাকে, যা অতি উচ্চমাত্রায় আসক্তি তৈরি করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য মতে, ভ্যাপিংয়ের ফলে ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং যা মস্তিষ্কের কাছে প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি পৌঁছে দেয়। এতে করে খুব সহজেই মস্তিষ্ক ভ্যাপরকে তার প্রশান্তিদায়ক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে এবং তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

কীভাবে কাজ করে সিগারেট?

ই-সিগারেটের ভেতরে নিকোটিন, প্রোপাইলিন গ্লাইকল অথবা ভেজিটেবল গ্লিসারিন এবং সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে। কিন্তু তামাকের ভেতর থাকা অনেক বিষাক্ত রাসায়নিকের তুলনায় (যেমন টার এবং কার্বন মনোক্সাইড) নিকোটিন তুলনামূলক কম ক্ষতি করে বলে দাবি ব্যবহারকারীদের।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকোটিন হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করে থাকে বলে গবেষণায় প্রমাণিত। নিকোটিন উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা তৈরি করে থাকে। এটা শ্বাসতন্ত্রেও ক্ষতি করে থাকে।

‘তামাকজাত পণ্যের চেয়ে কম ক্ষতিকর এবং তামাকজাত পণ্যের নেশা কমিয়ে দেয়’— এই যুক্তিতে বাজারে আনা হলেও বর্তমানে এর ব্যবহার নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্তৃত গবেষণা।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এফডিএ মার্কেট থেকে ই-সিগারেট তুলে নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর পরিসংখ্যান অনুসারে সেখানে ৩৬ লাখ তরুণ এটা ব্যবহার করে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা স্কট গুটিলেব জানান, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থটি অত্যন্ত উচ্চমানের এডিক্টিভ (নেশা সৃষ্টিকারী)। তরুণরা মনে করে এটা তামাকজাত দ্রব্যের চেয়ে নিরাপদ। কিন্তু এটা মোটেও নিরাপদ নয়।

তিনি জানান, বেশ কিছু গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে ই-সিগারেটে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে, ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দ্বিগুণ ঝুঁকি রয়েছে।

২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট ই-সিগারেট গ্রহণে শ্বাসযন্ত্রের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয় বলেও জানান দেশটির এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুস জনিত রোগে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৮০৭ জন। এর মধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেটে আসক্ত ছিলেন।

সিগারেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে কেনো?

ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানিয়ে এটি গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। এই প্রচারণার সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানাভাবে ই-সিগারেটকে নিরাপদ দাবি করে প্রচারণা চালিয়ে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। কিছুক্ষেত্রে ধূমপান আসক্তি থেকে মুক্ত হতে ই-সিগারেটের ব্যবহারকে স্বাস্থ্যকর বলেও প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ধূমপানের চাইতে কম ক্ষতিকর এমন প্রচারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং সাম্প্রতিক সময়ে নানা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ধূমপানের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়ে থাকে এই ই-সিগারেট ব্যবহারে।

মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ডব্লিউএইচও এর ২০২১ সালের তথ্য মতে, বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭ শতাংশ বেড়েছে। স্বাদ বা গন্ধ পছন্দ হওয়ায় হাইস্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে।

বাংলাদেশেও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টের ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডা-স্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয় কেন্দ্র।

সিগারেটের ক্ষতিকর দিক

ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা সরাসরি নিকোটিনের সংস্পর্শে আসেন এবং এটি কিশোর মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বিকাশে এটি নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ই-সিগারেটে অ্যাসিটালডিহাইড (সম্ভাব্য কার্সিনোজেন), ফর্মালডিহাইড (পরিচিত কার্সিনোজেন), অ্যাক্রোলিন (টক্সিন) এবং নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিসার মতো ধাতুসহ কমপক্ষে ৮০টি ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে।

ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬-এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (GATS) ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালিত হয় বলে এই গবেষণার মাধ্যমে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট ব্যবহারে প্রকৃত চিত্র পাওয়া কঠিন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে পরিচালিত গেটস অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার শূন্য দুই শতাংশ।

ই-সিগারেটকে হিট-নট-বার্ন বা যে নামেই অবহিত করা হোক না কেন, এ ধরনের পণ্যকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২০টি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে একটি ই-সিগারেট।

ই-সিগারেট ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। এর মধ্যে যে উপাদানগুলো পাওয়া যায় তা শরীরের বিভিন্ন সেলকে বিকলসহ ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এতে যে তরল পদার্থ (ই-লিকুইড) থাকে সেখানে প্রোপাইলিন গ্লাইকল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইকল, নানাবিধ ফ্লেভার ও নিকোটিন থাকে। এ রাসায়নিকগুলো গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন করে। যা মানবশরীরের রক্ত সঞ্চালনকে অসম্ভব ক্ষতি করে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, বাংলাদেশ ২০১৭ অনুসারে, ৬.৪ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্কই ই-সিগারেটের বিষয়ে অবগত, ০.৪ শতাংশ কখনও ব্যবহার করেছেন এবং ০.২ শতাংশ ব্যবহার করেছেন। ২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন এবং ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।

সম্প্রতি ‘ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস’- এর কারিগরি সহায়তায় ঢাকা শহরের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে ঢাকা আহছানিয়া মিশন। ওই গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত ই-সিগারেট ওপেন সিস্টেম (রিফিল ট্যাংকযুক্ত) এবং ক্লোজ সিস্টেম (ডিসপোজেবল কার্টিজযুক্ত)— এ দুই ধরনের হয়ে থাকে। ই- লিকুইড ফ্লেভারের ভিন্নতা এবং ধোঁয়া নিয়ে বেশি কারুকাজ করার সুযোগ থাকে বিধায় বেশির ভাগ ব্যবহারকারী শিক্ষার্থী ওপেন সিস্টেম (রিফিল ট্যাংকযুক্ত) পছন্দ করেন।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রথমে ই-সিগারেট সেবনের সময় বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী নিশ্চিত ছিলেন না যে এতে নিকোটিন আছে কি না। অংশগ্রহণকারীরা ই-সিগারেটের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করতেন ই-সিগারেট সম্পর্কে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল না যে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অংশগ্রহণকারীদের নিকোটিন সম্পর্কে মিশ্র জ্ঞান ছিল। তারা ই-সিগারেট ও প্রচলিত সিগারেটের মধ্যে নিকোটিনের পার্থক্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তাদের কেউ কেউ আবার মনে করতেন যে ই-সিগারেটে প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় নিকোটিন কম থাকে।

কীভাবে ই-সিগারেটের সংস্পর্শে আসা— এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানান, তারা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বড় ভাই-বোন, বন্ধু, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সিনেমা, শপিং মল বা উপহারের দোকান থেকে ই-সিগারেট সম্পর্কে শোনেন। বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপনগুলো সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে দেখেছেন। অনেকে বন্ধুদের সঙ্গে তাদের প্রথম ই-সিগারেট সেবনের চেষ্টা করেন।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ই-সিগারেট অনেক সময় দেখা যায় শখের বশে তরুণদের ব্যবহার করতে। কিন্তু ধীরে ধীরে এটিই আসক্তিতে রূপান্তর হয়। মানুষের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট (মস্তিষ্কের উন্নয়ন) ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত চলমান থাকে। ই-সিগারেট ব্যবহারের কারণে শিশু-কিশোরদের এটি ব্যাহত হয়। ই-সিগারেট একটি নেশা তৈরি করে। আর নেশাগ্রস্ত হলে একটি মানুষ অসামাজিক হয়ে যায়। যখন সে ই-সিগারেট না পায়, তখন সে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তার আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আসে।

তিনি বলেন, ধূমপানের মাধ্যমে যে ক্ষতিগুলো হয় তার প্রত্যেকটি ই-সিগারেটের মাধ্যমে হয়। এটি মানুষের জন্য যে ক্ষতিকর, সেটি চিহ্নিত করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে। মেডিসিন ও মানসিক চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সোসাইটিগুলো ই-সিগারেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ই-সিগারেটের নিকোটিন আল্ট্রাসনিক, এগুলো ফুসফুসের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে শ্বাসতন্ত্রে রোগ তৈরি হয় এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। ফুসফুসের কোষগুলো নষ্ট হতে হতে এমন অবস্থা তৈরি হয়, যা আর কখনওই ভালো হয় না।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের শিশু-কিশোরসহ সব তরুণকে নেশার ছোবল থেকে রক্ষার জন্য একটি জাতীয় গাইডলাইন থাকা উচিত। এই গাইডলাইনের মধ্যে তামাক বা তামাকজাত পণ্য নিষিদ্ধ থাকবে। ই-সিগারেট, ভ্যাপ বা সিসা— তরুণদের নেশার জগতে নিয়ে যায়, এমন সবকিছু নিষিদ্ধ করতে হবে। এর বিপরীতে তাদের জন্য খেলাধুলার মাঠ, বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ বিকাশমান শিশু-কিশোরদের যদি আমরা সৃজনশীল পথে পরিচালিত করতে না পারি তাহলে তারা নেশার বিষাক্ত নীল ছোবল থেকে বাঁচতে পারবে না।

তিনি বলেন, তামাক কোম্পানিগুলোর টার্গেট তরুণরা। তাদের যারা সচেতন হয়ে তামাকটা নিচ্ছে না, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ই-সিগারেট। বলা হচ্ছে, এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। অথচ বাস্তবতা একেবারেই বিপরীত। ই-সিগারেটের ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়েও আমরা কথা বলছি।

তিনি আরও বলেন, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশ এ ধরনের সিগারেট কারও মালিকানায় থাকার ওপরও দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নরওয়ে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীদের ওপর বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আমাদের দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।

সিগারেট নিয়ে সরকারের অবস্থান

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে শক্তিশালী করতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল। খসড়া সংশোধনীতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি কয়েকটি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এসব সংশোধনীর মধ্যে রয়েছে— পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান এলাকা রাখার বিধান বিলুপ্ত করা; বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য বা প্যাকেট বা মোড়ক দৃষ্টির আড়ালে রাখা; তামাক কোম্পানির নিজে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিএসআর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করা; ই-সিগারেট, ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ সব ধরনের নতুন তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা; প্যাকেট, মোড়ক বা কোটা ছাড়া খুচরা বা খোলা তামাকপণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্যাকেট, মোড়ক ও কোটার ন্যূনতম ৯০ শতাংশ পরিমাণ জায়গাজুড়ে মুদ্রণ করা।

এছাড়াও, কেউ এই ধারা লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। পাশাপাশি, যেকোনো ব্যক্তির জন্য এসব পণ্যের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালী করণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত, ওবেসাইটে প্রকাশ এবং অংশীজনের মতামত গ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। যেখানে, শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা এবং খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করাসহ ই–সিগারেট নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সারাবাংলা/এসবি/এএম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

গুলশানে দুইজনের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:৫৫

ঢাকার পথে প্রধান উপদেষ্টা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৩

সম্পর্কিত খবর