এমপি লিটন হত্যাকাণ্ড: ফাঁসির আসামি চন্দন গ্রেফতার
১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:৩২
ঢাকা: গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে সংসদ সদস্য (এমপি) মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডের প্রধান সমন্বয়কারী ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি হওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চন্দন কুমার রায়কে সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালে ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ এলাকায় নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় গাইবান্ধা-১ আসনের (সুন্দরগঞ্জ) এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে।
মামলার তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। যার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের প্রধান সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায় ছাড়া বাকি ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারক।
রায়ে পলাতক আসামি চন্দনসহ ৭ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত।
এদের মধ্যে একজন আসামি সুবল চন্দ্র কারাগারে বিচারাধীন থাকাকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পলাতক চন্দন কুমার রায়কে গ্রেফতারে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাবের যৌথ অভিযানে সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা খেকে হত্যা মামলার প্রধান সমন্বয়কারী ও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি চন্দন কুমার রায়কে (৪৩) গ্রেফতার করা হয়।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ সংসদীয় আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের পরিকল্পনাতে হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়। আবদুল কাদের খান ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুন্দরগঞ্জ এলাকায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সংসদ সদস্য থাকাকালীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার দুর্নীতির বিষয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন অভিযোগ উথাপন করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসন হতে নিহত মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন তৎকালীন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। পূর্বের পুঞ্জীবিত ক্ষোভ, রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও তৎকালীন সংসদ সদস্যকে সরিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য হওয়ার লোভে মূলত হত্যাকা-ের পরিকল্পনা করে আবদুল কাদের খান। ২০১৬ সালে প্রথম দিকে এমপি লিটন’কে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে গ্রেফতারকৃত চন্দন কুমার রায়’কে জানান আবদুল কাদের খান। গ্রেফতারকৃত চন্দন ও আবদুল কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ৩১ ডিসেম্বর এমপি লিটন’কে তার নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়।
জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত চন্দন কুমার রায় সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর বিষয়ক সম্পাদক ছিল। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় এমপি লিটনের সমর্থিত লোকজনের সাথে তার মারামারির ঘটনা ঘটে এবং গ্রেফতারকৃত চন্দন গুরুতর আহত হয়।
গ্রেফতার চন্দনের ভাষ্যমতে, এমপি লিটনের প্ররোচনায় একই সময়ে একটি মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে এবং ওই মামলায় চন্দন ১৯ দিন কারাভোগ করে। তার বিরুদ্ধে থাকা চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য মামলা হতে অব্যাহতি পেতে সে এমপি লিটনের সহযোগিতা চায়। কিন্তু এমপি লিটন তাকে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বলায় সে এমপি লিটনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৬ সালের প্রথমদিকে এমপি লিটন তাকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে আবদুল কাদের খানের পিএস ও এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সহযোগী শামসুজ্জোহার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে আবদুল কাদের খানের সঙ্গে তার সখ্যতা তৈরি হয়। চন্দনের ভগ্নিপতি সুবল রায় এমপি লিটনের বাড়ির দারোয়ান হিসেবে কাজ করার সুবাদে এমপি লিটনের গমনাগমনের বিষয়ে তথ্য জানা সহজ ছিল চন্দনের। এমপি লিটনকে হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় আবদুল কাদের খান গ্রেফতারকৃত চন্দনের সহযোগিতায় হত্যাকান্ডের নতুন পরিকল্পনা করেন বলে জানায়।
এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চন্দন প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এমপি লিটনের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে আবদুল কাদের খান ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যান্য সহযোগীদেরকে তথ্য প্রদান করত গ্রেফতার চন্দন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে তাদের সহযোগী মেহেদী, শাহীন, রানা, শামসুজ্জোহা ও ড্রাইভার হান্নান অস্ত্র চালানো ও হত্যাকান্ডের পর দ্রুত পালানোর প্রশিক্ষণ নেয়।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চন্দন এমপি লিটনের ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আগমনের তথ্য দেয়। তারা মাঝপথে হত্যার পরিকল্পনা নিলেও এমপি লিটন গাবতলী এসে ফিরে যাওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তারা এমপি লিটনকে তার নিজ বাড়িতেই হত্যার পরিকল্পনা করে। সেই মোতাবেক ঘটনার দিন ৩১ ডিসেম্বর লিটনের চাচাতো ভাই সুবল এবং গ্রেফতার চন্দন বাড়িতে অবস্থান করে এবং এমপি লিটন কখন কি অবস্থায় থাকে ওই সংক্রান্ত খোঁজখবর অন্যান্যদের দিতে থাকে।
ওইদিন বিকেলে গ্রেফতার চন্দন জানায় যে, এমপি লিটন তার নিজ বাড়িতে একা অবস্থান করছে। পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যাকারী শাহীন, রানা ও মেহেদী মোটরসাইকেলযোগে এমপি লিটনের বাড়িতে যায় এবং নৃশংসভাবে গুলি করে কিলিং মিশন সম্পন্ন করে। হত্যাকান্ডের পর জড়িত আবদুল কাদের খানসহ জড়িত ৭ জনকে গ্রেফতার করা হলেও গ্রেফতার চন্দন পাশের দেশে আত্মগোপন করায় সে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। হত্যাকাণ্ডের আনুমানিক ১৫/১৬ দিন পর সে তার আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় ভারতে আত্মগোপন করে।
জানা যায় যে, গ্রেফতার চন্দন কুমার রায় ২০১০ সালের দিকে রাজধানীর একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করে। দুই বছর সাংবাদিকতা করার পর গাইবান্ধায় ফিরে স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। হত্যাকান্ডের পর চন্দন ভারতে পালায় এবং নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে শাওন রায় নামে ভূয়া নাগরিকত্ব, আধার/রেশন কার্ড করে সেখানে অবস্থান করে। ভারতে অবস্থানকালীন সে রংপুর ও গাইবান্ধা সীমান্ত কাছে হওয়ায় গাঁজা, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের চালান বাংলাদেশে পাঠাত। সম্প্রতি মাদক সংক্রান্ত কাজে সে কিছুদিন যাবত সাতক্ষীরায় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করছিল। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার চন্দনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
সারাবাংলা/ইউজে/একে