Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় ডিভাইস আসক্তির কারণে বেড়েছে শিশুর ক্ষীণদৃষ্টির ঝুঁকি

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৯ জুন ২০২২ ১৬:২০

ঢাকা: রাজধানীর একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থী ৮ বছর বয়সী নাফিসা ইসলাম (ছদ্মনাম)। চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে ২০২১ সাল থেকে চশমা ব্যবহার করছেন। তিন মাস আগে অর্থাৎ মার্চ মাসেই চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করেছেন।

নাফিসার বাবা কামাল ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, ওর জন্মের পর থেকে চোখে তেমন সমস্যা আমরা দেখি নি। স্কুলে ভর্তি করার পরেও তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায় নি। তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হলে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় ওর সময় কাটানোর জন্য আমরা ও মোবাইল ফোনে গেইম খেললেও কিছু বলতাম না। স্কুলের রুটিনও তখন তেমন ছিল না।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, সেই যে মোবাইলের অভ্যাস হয়েছে নাফিসার আজও সেটা ছাড়াতে পারি নাই। প্রথমদিকে আমরা বুঝি নি। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ওর কিছু উপসর্গ দেখা দেয় চোখে সমস্যার। ঘুমাতে গেলেই বলতো মাথা ব্যথা করে, চোখে পানি পড়ে ও ব্যথা করে। এরপরে আমরা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। সেখানে বুঝতে পারি ওর দূরের দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে।

কেনো এমনটা হচ্ছে জানতে চাইলে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জানান, প্রায় দুই বছর শিশুরা ঘরবন্দি। কাজ না থাকায় সারাক্ষণ স্ক্রিনের সীমাবদ্ধ ছিল শিশুদের চোখ। ফলে তারা তেমনিভাবে দূরের জিনিস দেখেনি। এ কারণে তাদের দূরের দৃষ্টিশক্তি ঠিকমতো তৈরিই হচ্ছে না।

তিনি বলেন, আট বছর পর্যন্ত শিশুদের চোখের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। এই বয়সের শিশুরা যদি দূরের জিনিস না দেখে তাহলে আস্তে আস্তে দূরের দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে ফেলবে। বড় হওয়ার পরেও তাদের এই সমস্যা কাটবে না। এই সমস্যাটির নাম মায়োপিয়া।

বিজ্ঞাপন

মায়োপিয়া কী?

মায়োপিয়া একটি খুব সাধারণ দৃষ্টিশক্তি ত্রুটি। প্রতিসরণমূলক ত্রুটিগুলির মধ্যে মায়োপিয়া হল সবচেয়ে সাধারণ, অর্থাৎ সেই সমস্ত ব্যাধিগুলি যা চোখের চিত্রগুলিকে তীক্ষ্ণভাবে ফোকাস করতে অক্ষমতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়।

এটি সাধারণত স্কুল বয়সে ঘটে, বিকাশের সময়কালে বৃদ্ধি পায় এবং প্রায় ২০-২৫ বছর বয়সে স্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকে, সেই বয়সের পরে সামান্য বৃদ্ধি পায় (যদি না কিছু নির্দিষ্ট প্যাথলজি এটিকে দ্রুত খারাপ করে দেয়)।

মায়োপিয়া এমন একটি সমস্যা যা দূরত্বে বস্তুগুলিকে ভালভাবে দেখাতে বাধা দেয়। এটির সূচনা একটি জেনেটিক প্রবণতার উপর নির্ভর করে, তবে জীবনধারার কারণগুলি, যেমন বন্ধ, খারাপ আলোকিত জায়গায় অনেক ঘণ্টা ব্যয় করা, টিভি, কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের স্ক্রিনে আপনার চোখ স্থির রাখা, এটির ঘটনা বা খারাপ হওয়ার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।

মায়োপিয়ার কারণ

মায়োপিয়ার জেনেটিক কারণ রয়েছে। মায়োপিক লোকদের চোখ স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা হয়, যার মানে দূরবর্তী বস্তু থেকে আসা আলোর রশ্মি রেটিনার (চোখের ভিতরের ঝিল্লি) উপর ঠিক ফোকাস করে না, যেমন তারা স্বাভাবিক চোখে থাকে, কারণ তারা এটির সামনে নিবদ্ধ থাকে। এর ফলে দূরত্বের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অসংখ্য গবেষণায় মায়োপিয়া এবং জীবনধারার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

বিশেষ করে, এই ব্যাধিটির ঘটনা বেশি ঘটে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে, যারা কৃত্রিম আলো এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনের মাধ্যমে বাড়ির ভিতরে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে যার জন্য তাদের চোখের কাছাকাছি রাখা বস্তুগুলিকে কয়েক ঘণ্টা ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

এইভাবে, কম্পিউটারের ব্যবহার কিশোর মায়োপিয়াকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে, কারণ এটি বাড়ির অভ্যন্তরে সম্পাদিত একটি প্রক্সিমাল কার্যকলাপ।

করোনার প্রভাবে মায়োপিয়া

শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাকালে কয়েকটি কারণে শিশুদের মধ্যে এ সমস্যা বাড়তে পারে—১. স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরে থাকা। ২. দিনের আলো চোখে কম পড়া। ৩. অনলাইনে বিরতিহীনভাবে দীর্ঘ সময় ক্লাস করা। ৪. মুঠোফোনের মতো ডিজিটাল ডিভাইসের পর্দায় (স্ক্রিনে) সময় বেশি দেওয়া।

চীনে পরিচালিত এক গবেষণায় করোনাকালে শিশুদের মধ্যে এ সমস্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা উঠে এসেছে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মেডিকেল জার্নাল জ্যামা অফথালমোলজিতে গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘২০২০-এ ইয়ার অব কোয়ারেন্টিন মায়োপিয়া’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে ছয় থেকে আট বছর বয়সী শিশুদের মায়োপিয়ার হার আগের চেয়ে ১ দশমিক ৪ থেকে ৩ গুণ বেড়েছে।

বাংলাদেশে মায়োপিয়ার পরিস্থিতি কী?

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় ২১ হাজার শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অথচ ২০২০ সালের ১২ মাসে চিকিৎসা দেওয়া হয় ৬১ হাজার জনকে।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির বহির্বিভাগে ৪৪ হাজার ৫০০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ২০২১ সালের প্রথম চার মাসেই ১৮ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. রাহাত আনোয়ার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, শিশুর হাতে ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দিচ্ছে তাদের বাবা-মা। এতে অধিকাংশ শিশুরই ওই যন্ত্রগুলোর ওপর আসক্তি বাড়ছে। ফলে শিশুদের অধিকাংশই বেড়ে উঠছে মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে। অতিমাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে অনেক শিশুই অন্ধও হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘শিশুদের যে বয়সে দূরের দৃষ্টি তৈরি হওয়ার কথা সেই সময় তারা বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এ কারণে অল্প বয়সেই তাদের চোখে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে কম বয়সেই শিশুর চোখে উঠে যাচ্ছে চশমা। অতিমাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন নির্ভরতার কারণে বড়দের চেয়ে শিশুদের চোখে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ক্ষতি হয়। সেই কারণে মায়োপিয়াসহ নানাধরনের চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে শিশুদের।’

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জানান, করোনার কারণে মায়োপিয়া রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ স্বাভাবিক হওয়ার পরে আমরা দেখি হাসপাতালে রোগী অনেকগুণ বেড়েছে। লক ডাউনের মধ্যে আমাদের হাসপাতালে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখলেও এখন এই সংখ্যা বেড়ে ৩০০ খেকে ৪০০ হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই দূরে দেখার দৃষ্টিতে সমস্যা নিয়ে আসে। তার একটি বড় অংশ শিশুরা।

তিনি বলেন, করোনার আগে ২০১৯ সাল ও ২০২০ সালে ২০ থেকে ২২ শতাংশ ছিল মায়োপিয়া। করোনার মধ্যে এ জাতীয় রোগীর হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ করোনা মধ্যে শিশুদের ডিভাইসে আসক্তি।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, টানা কম্পিউটার, মোবাইল বা যে কোনও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে তাকিয়ে থাকাটা বড় ছোট সবার চোখের জন্যই ক্ষতিকর। ছোটদের বেলায় সেটা আরও বেশি ক্ষতিকর। অভিভাবকদের অনেকে ভাবেন, শিশুদের চোখের সমস্যা বোধহয় কম হয়। যার কারণে তারা পরীক্ষাও করান না। এসব শিশুর জন্য তখন সমস্যাটা আরও প্রকট হয়।

তিনি বলেন, এই সমস্যা সমাধানে পরিবারের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশেষ করে যদি শিশুরা জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত থাকে তবে তাদের শাকসবজি খাওয়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়াও তাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটাতে হবে যেনো মোবাইল আসক্তি কমানো যায়।

তিনি আরও বলেন, করোনার সময়ে আসলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক—দুই ধরণের সমস্যা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ও ডিভাইস আসক্তি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শিশুদের দূরত্ব বাড়িয়েছে। মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে শিশুরা শুধুমাত্র ডিভাইস আসক্তির কারণে। একটানা ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে শিশুদের মাঝে এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে। সমাধান করতে হলে অবশ্যই তাদেরকে ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে। আর সেক্ষেত্রে পরিবারের সবাইকে শিশুদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম বা পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় কাটাতে হবে। যেনো তার মাঝে সেই ডিভাইস আসক্তি কম কাজ করে।

দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। নানারকম বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ঘোষণা করা হয় ছুটি। সংক্রমণ চলাকালীন দীর্ঘ সময়ের প্রভাব পড়েছে দেশের শিশু-কিশোরদের মাঝে। দীর্ঘ সময় শারীরিক চর্চার ঘাটতি একদিকে যেমন বাড়িয়েছে শিশুদের নানা রকম অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিক একইভাবে বাড়িয়েছে মানসিক অসুস্থতা। কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রভাবে দেশের শিশুদের মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকিগুলো নিয়ে সারাবাংলার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ ও শেষ পর্ব।

আরও পড়ুন:

প্রথম পর্ব: করোনার প্রভাবে শিশুদের মাঝেও দেখা দিচ্ছে ডায়াবেটিস

দ্বিতীয় পর্ব: কমছে খেলার মাঠ, বাড়ছে শিশুদের আত্মহননের প্রবণতা

তৃতীয় পর্ব: করোনায় অতিমাত্রায় ডিভাইস আসক্তিতে বেড়েছে শিশুর মানসিক অসুস্থতা

সারাবাংলা/এসবি

করোনা করোনায় শিশুরা মায়োপিয়া শিশু শিশুদের চোখ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সিটিকে রুখে দিল নিউক্যাসেল
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:০৮

সম্পর্কিত খবর